পরিবহন দুর্ঘটনা: এক বছরে চার হাজার প্রাণহানি

0

চলতি বছরের মার্চে রাজশাহীতে বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষের পর আগুন ধরে যায় একটি মাইক্রোবাসে। ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনায় নিহত হন ১৭ জন। সর্বশেষ গত ২৩ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে লঞ্চে আগুন লেগে এখন পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। নিখোঁজ রয়েছেন বেশ কয়েকজন। দেশের পরিবহন খাতে ছোট-বড় এমন দুর্ঘটনা ঘটছে প্রতিদিনই। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তথ্য বলছে, চলতি বছর তিন হাজারের বেশি পরিবহন দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেছে প্রায় চার হাজার মানুষের।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে সড়ক, রেল ও নৌ দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ১৮২টি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৩ হাজার ৮৪০ জন। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্ঘটনার সংবাদ বিশ্লেষণ করে তথ্যগুলো প্রস্তুত করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

বরাবরের মতো চলতি বছরও সবচেয়ে বেশি সংঘটিত হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। মোট পরিবহন দুর্ঘটনার মধ্যে ৩ হাজার ২৯টিই সংঘটিত হয়েছে সড়কে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩ হাজার ৫৮৯ জন। আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৯০৭ জন। এছাড়া ৮৯টি ট্রেন দুর্ঘটনায় ৯১ জন নিহত ও ২৪ জন আহত হয়েছেন। ৬৪টি নৌ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৫৮ জন। আহত হয়েছেন ৮৮ জন।

বছরের অবশিষ্ট ১৯ দিনে সুগন্ধায় লঞ্চে আগুনসহ সড়ক ও ট্রেন দুর্ঘটনায় আরো শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সব মিলিয়ে চার হাজারের বেশি মানুষ পরিবহন দুর্ঘটনায় মারা গেছেন চলতি বছর। তবে নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হিসাবে দুর্ঘটনা ও হতাহতের পরিমাণ আরো বেশি।

পরিবহন খাতে নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনা এসব দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বলে মনে করছেন বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান। তিনি বলেন, আমাদের দেশে পরিবহন খাতে অবকাঠামোগত দুর্বলতা প্রকট। পরিবহন শ্রমিকরা অদক্ষ। পুরো পরিবহন ব্যবস্থা অনিয়ম আর বিশৃঙ্খলায় ভরা। নিয়ন্ত্রক ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। একই সঙ্গে নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকেও দুর্ঘটনা রোধে সময়োপযোগী তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না। ফলে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্য থাকলেও আমরা হাঁটছি উল্টোপথে। দুর্ঘটনা কমার বদলে প্রতি বছরই বাড়ছে।

মোটা দাগে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ১০টি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছে নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, তরুণ ও যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সক্ষমতার ঘাটতি ও গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজিকে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করেছে সংগঠনটি।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির হার ঊর্ধ্বমুখী হলেও তা নিয়ন্ত্রণে সরকারের তেমন কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ বাস্তবায়নেও কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। দুর্ঘটনা ঘটছে মূলত সড়ক পরিবহন খাতের নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার কারণে। এ অবস্থার উন্নয়নে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস ও পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর লক্ষ্যে ২০১৯ সালে সাবেক নৌ-পরিবহনমন্ত্রী ও শ্রমিক নেতা শাজাহান খানের নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটি ১১১টি সুপারিশ করেছিল। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সুপারিশগুলোর দৃশ্যমান কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। একই অবস্থা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্ন্যান্স ইনোভেশন ইউনিটের ১৮টি নির্দেশনার।

সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে পরিবহন মালিক-শ্রমিক গোষ্ঠীকে দায়ী করছেন নিরাপদ সড়কের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা অভিনেতা ও নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন। তিনি বলেন, বর্তমানে সড়কে যেসব নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা বিদ্যমান, সেগুলো পরিবহন মালিক-শ্রমিকরাই তৈরি করেছেন, ফলে সড়ক নিরাপদ তো নয়ই, উল্টো দিন দিন আরো অনিরাপদ হচ্ছে।

যানবাহনের মালিক, চালক, সড়ক ব্যবহারকারী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনকে নিয়ে নিরাপদ সড়ক গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন দেশের সড়ক পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার। তিনি বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে চাই। এজন্য একটি ন্যাশনাল রোড সেফটি স্ট্র্যাটেজিক অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ধাপে ধাপে দুর্ঘটনার পরিমাণ কমিয়ে আনা হবে। এ কৌশলগত পরিকল্পনা তখনই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে, যখন সড়ক ব্যবহারকারীরা আরো দায়িত্বশীল ও আন্তরিক ভূমিকা রাখতে শুরু করবেন। আমরা সে লক্ষ্যে নীতি পরিকল্পনা তৈরি এবং সেগুলো বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করছি।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com