এসএসসিতে অটোপাসের দাবি, দুর্ভাগ্যজনক বলছে বিশেষজ্ঞরা
সম্প্রতি মাধ্যমিক স্কুলের কিছু শিক্ষার্থী মানববন্ধন করে দাবি তুলেছে যে, উচ্চ মাধ্যমিক বা এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের মতো তাদেরও এসএসসি পরীক্ষা না নিয়ে অটোপাস দিতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের এই দাবিটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে।
এর আগে করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় এবং এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল করে তার পরিবর্তে অটোপাসের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। অন্য শ্রেণীর শিক্ষার্থীদেরও পরীক্ষা ছাড়াই পরবর্তী শ্রেণীতে তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এর জের ধরে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থীরাও একই দাবি তুলেছেন।
এর আগে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জানান, ২০২১ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা কিছুটা পিছিয়ে জুন মাসে, এবং এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা জুলাই-অগাস্ট মাসে নেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। অটোপাসের দাবিতে ২রা ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মানববন্ধন করে শিক্ষার্থীদের একটি দল। এর আগে জানুয়ারিতে প্রেসক্লাবের সামনেও বিক্ষোভ করেছে তারা।
অটোপাসের পক্ষে থাকা শিক্ষার্থীরা তাদের দাবির স্বপক্ষে যুক্তিতে বলেন, কোভিড-১৯ এর কারণে ১১ মাসেরও বেশি সময় স্কুল বন্ধ থাকায় পড়াশোনা করতে না পারায় পরীক্ষায় ভাল ফল করা সম্ভব না। সিলেবাস কমিয়ে আনা হলেও সেটি পুরোপুরি শেষ করা সম্ভব হবে না- যার কারণে অটোপাসের দাবি তোলেন তারা। তারা বলছেন, পিএসসি এবং জেএসসি পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে এসএসসি পরীক্ষার ফল দেয়া হোক।
২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষা বাতিল চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও একাধিক গ্রুপ এবং পেইজ তৈরি হয়েছে। এরকম একটি গ্রুপ ‘২০২১ এসএসসি বাতিল চাই (অফিসিয়াল)। গ্রুপটির সদস্য সংখ্যা ৭৩ হাজারের বেশি। এই গ্রুপটির সদস্যরা এসএসসি পরীক্ষা বাতিল এবং ফেব্রুয়ারির মধ্যে অটোপাসের ঘোষণার দাবি জানায়।
এমডি শিমুল নামে একজন গ্রুপটিতে পোস্ট করে বলেছেন, ‘২২ লক্ষ শিক্ষার্থীর দাবি এসএসসি ২১ পরীক্ষার অটোপাসের ঘোষণা।’ মোহাম্মদ আরাফাত নামে একজন বলেছেন, ‘৫০% সিলেবাস সর্ট করলে আমরা ৬ মাস ক্লাস চাই।’
এছাড়া রাজধানীর ফার্মগেট ছাড়াও নরসিংদী, গাজীপুর, ময়মনসিংহ-সহ বিভিন্ন জেলা থেকে অটোপাসের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও বিক্ষোভের ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে এই গ্রুপটিতে। তবে শিক্ষার্থীদের অনেকের ভিন্নমতও রয়েছে।
ঢাকার একটি স্কুলের ২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী নাইমা রহমান। তিনি জানান, পরীক্ষা বাতিল নয় বরং পরীক্ষা দিতে চান তিনি। পিএসসি এবং জেএসসির পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে এসএসসি পরীক্ষার ফল দেয়া হলে সেটি ভাল আসবে না বলে জানান তিনি। ওই দুই পরীক্ষায় তিনি ভাল ফল করতে পারেন নি। আর এ কারণেই এসএসসি পরীক্ষায় ভাল ফল করতে করোনার সময় বাসায় থাকলেও পড়াশোনা চালিয়ে নেয়ার কথা জানান মিস রহমান।
‘অবশ্যই পরীক্ষা দিতে চাই। আমি এতো কষ্ট করে পড়ছি, এক বছর দুই বছর ধরে, কোচিংয়ে গেছি এতো দূরে, আমার তো কষ্ট হয়েছে। আমি কষ্ট করছি একটা ভাল রেজাল্ট করার জন্য।’
এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন মেহনাজ শাহরিয়ার আহমেদ। তিনি বলেন, এসএসসি পরীক্ষার জন্য যদি সিলেবাস কমিয়ে দেয়া হয় তাহলে অটোপাস চান না তিনি। তবে সিলেবাস না কমানো হলে অটোপাস চান বলে মত দিয়েছেন মিস আহমেদ।
‘যদি সিলেবাসটি একেবারেই কমানো না হয়, তাহলে অটোপাস ঠিক আছে।’
তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে পুরো এক বছর স্কুল বন্ধ থাকার কারণে ক্লাস করতে না পারেননি তারা। তবে অটোপাস দেয়া হলে ভবিষ্যতে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হতে পারে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে মিস আহমেদ বলেন, ‘আমরা তো পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের অসুবিধা হবে না। যারা বন্ধ করে দিয়েছে, তাদের সমস্যা হতে পারে।’
এসএসসি পরীক্ষা বাতিল করা নিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে সাথে অভিভাবকদের মধ্যেও রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ কেউ অটোপাসের পক্ষে মত দিলেও অনেকে আবার এর বিপক্ষে মত দিয়েছেন। এসএসসি পরীক্ষার্থীর মা মরিয়ম আক্তার মনে করেন অটোপাসের তুলনায় পরীক্ষা হলেই ভাল।
তিনি বলেন, পরীক্ষা হলে মেধার মূল্যায়ন হওয়ার একটা সুযোগ থাকে। কিন্তু অটোপাস হলে সেই সুযোগ বাদ হয়ে যায়। সে কারণেই পরীক্ষা চান তিনি।
তবে আরেক শিক্ষার্থীর মা শিলা ইকবাল বলেন, তার ছেলে পড়াশুনায় কিছুটা দুর্বল। আর তাই পরীক্ষা নেয়া হলে কম সময়ে সিলেবাস শেষ করতে পারবে না সে। ফলে পরীক্ষায় খারাপ ফলের আশঙ্কা রয়েছে। আর এজন্য অটোপাসের পক্ষেই মত দিয়েছেন তিনি।
‘জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক’
শিক্ষাবিদ এবং এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, এসএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য যদি অটোপাসের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তাহলে সেটি হবে দুর্ভাগ্যজনক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের অটোপাস দেয়া হলেও তারা তাদের পুরো দুই বছরের পড়াশোনা এবং পরীক্ষার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিল। শুধু পরীক্ষা নেয়াটা সম্ভব হয়নি। তবে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে সেটাও হয়নি। যার কারণে ভবিষ্যতে তারা সমস্যায় পড়তে পারেন বলে মত দিচ্ছেন তারা।
এ বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘আমাদের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা যদি এখন অটোপাসের পথ খোঁজে, তাহলে সেটা দেশের জন্য দুর্ভাগ্যজনক।’
তিনি বলেন, ‘যে দেশ থেকে বিদেশিরা পরামর্শ এবং বিশেষজ্ঞ ফি বাবদ প্রতি বছর ৩৫ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যায়, সে দেশে মানুষ থাকার পরও আমরা কাজ করতে পারি না, আমরা দক্ষ না, আর এর মধ্যে যদি অটোপাসের আবর্তে পরি তাহলে আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ হবে।’
কায়কোবাদ বলেন, দেশকে এগিয়ে নিতে হলে দক্ষতা অর্জন এবং জ্ঞান অর্জন করাটা জরুরী। সেটা না করে যদি শিক্ষার্থীরা অটোপাসের দিকে ঝুঁকে তার মানে হচ্ছে যে তিনি জ্ঞান অর্জনের সাথে যুক্ত নাই। বাংলাদেশের মতো অপ্রতুল সম্পদ রয়েছে এমন দেশে তরুণ সমাজ কাজ বা দক্ষতা অর্জনে বিমুখ হলে সেটি দুশ্চিন্তার বিষয় বলে মনে করেন তিনি।
তবে কায়কোবাদ বলেন যে, করোনাভাইরাস মহামারীর সময়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষাবোর্ডের সদস্য কিংবা শিক্ষকদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখা উচিত ছিল।
সেসময় তাদের নানা ধরণের শিক্ষামূলক কার্যক্রম যেমন অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া কিংবা নির্দিষ্ট চ্যাপ্টার পড়তে দেয়া এবং নির্দিষ্ট সময় শেষে সেগুলো আদায় করে নেয়ার একটা ব্যবস্থা করা উচিত ছিল বলে মনে করেন তিনি। সেখানে সরকার কিছুটা ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন কায়কোবাদ। তবে অনলাইন ক্লাস এবং সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে এ ঘাটতি পুষিয়ে নিতে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেও সেটা পর্যাপ্ত ছিল না বলেও জানান তিনি।
একই ধরণের মত দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দা আতিকুন নাহার। তিনি বলেন, অটোপাস আসলে একটা বিশেষ পরিস্থিতির ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়। চলতি বছর কোভিডের কারণে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হয়নি বলে তাদের অটোপাস দেয়া হয়েছে।
এর আগে মুক্তিযুদ্ধের সময় আরেকবার অটোপাস দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেবছরও যুদ্ধের মতো একটি বিশেষ অবস্থা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমানে কোভিড পরিস্থিতি উন্নয়নের দিকে এবং টিকা দেয়াও শুরু হতে যাচ্ছে, তাই শিগগিরই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও খুলে দেয়া হতে পারে বলে জানান তিনি।
সৈয়দা আতিকুন নাহার বলেন, ‘অটোপাস একটা বিকল্প পন্থা, কিন্তু এটা কখনোই ভাল পন্থা নয়।’
তিনি মনে করেন, বিতর্ক থাকলেও পরীক্ষা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের একটি পদ্ধতি। এই মূল্যায়ন শিক্ষার্থীদের জন্য জরুরী, কারণ পরবর্তী পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থী কোন বিষয়ে পড়াশুনা করবে বা সে কী হতে চায় সেটি যাচাই করতে হলেও মূল্যায়নটা জরুরি।
‘মূল্যায়ন ছাড়া নিজের মেধাটাও যাচাই করা যায় না।’ এসএসসি পাসের পর পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষায় যাওয়ার প্রথম পরীক্ষা হিসেবে ধরা হয় এসএসসি-কে। সেকারণেই এটি গুরুত্বের সাথে নেয়াটা জরুরি।
তিনি বলেন, পরীক্ষা নেয়ার ক্ষেত্রে সিলেবাস কমিয়ে আনা যেতে পারে। কিন্তু পরীক্ষা বাতিল করাটা সমাধান নয়।
সূত্র : বিবিসি