ফিতরার পণ্যের পরিমাণ ও ফজিলত

0

সাদকাতুল ফিতর। গরিব অসহায় মানুষের আনন্দের অনুসঙ্গ। ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক ঘোষিত এবারের নির্ধারিত ফিতরার পরিমাণ- সর্বোচ্চ ২৩১০ টাকা এবং সর্বনিম্ন ৭৫ টাকা। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশিত আবশ্যক কাজ এটি। সাদকাতুল ফিতরের পরিমাণ হলো- এক সা’ খাদ্যদ্রব্য, এক সা’ খেজুর, এক সা’ যব বা এক সা’ কিসমিস। হাদিসে পাকে এসেছে-

হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়ে সাদকাতুল ফিতর হিসেবে এক সা খাদ্যদ্রব্য অথবা এক সা’ খেজুর অথবা এক সা’ যব অথবা এক সা’ কিসমিস প্রদান করতাম।’ (বুখারি)

হাদিসে খাদ্যদ্রব্য বলতে অনেকে গম বুঝিয়েছেন। ইসলামিক স্কলারদের মতে, অঞ্চলভেদে গম, ভুট্টা, পার্ল মিলেট কিংবা স্থানীয় খাদ্যদ্রব্য উদ্দেশ্য।

ফিতরা কী?

ফিতরা (فطرة) আরবি শব্দ; যা ইসলামে জাকাতুল ফিতর (ফিতরের যাকাত) বা সাদকাতুল ফিতর (ফিতরের সদকা) নামে পরিচিত। ফিতর বা ফাতুর বলতে সকালের খাদ্যদ্রব্য বোঝানো হয়। যা দ্বারা রোজাদারগণ রোজা ভাঙেন। গরিবের প্রতি ধনীর সহানুভূতি। ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গরিব-দুঃস্থ মানুষের মাঝে বিতরণ করা দানকে।

তবে স্থানীয় খাদ্যদ্রব্য হিসেবে বিবেচিত কিংবা ব্যবহৃত নয় এমন কিছু দিয়ে সহানুভূতি প্রকাশ করে ফিতরা দেওয়া কোনো মুসলিমের উপর আবশ্যক নয়। এ বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, অঞ্চলভেদে যেখানে যে জিনিসের ব্যবহার বেশি সেখানে তা (যব, খেজুর, কিসমিস, পনির) দিয়ে ১ সা’ পরিমাণে (পণ্য বা অর্থ দিয়ে) ফিতরা আদায় করা। তা দিয়ে ফিতরা আদায় করলে দোষের কোনো কিছুই নেই।

নবিজীর ফিতরার ঘোষণা

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদের প্রত্যেক স্বাধীন, নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, সবার ওপর সাদকায়ে ফিতর হিসেবে এক সা’ খেজুর অথবা এক সা’ জব ফরজ করেছেন এবং (ঈদের) নামাজে বের হওয়ার আগেই এটা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)

সাহাবাদের ফিতরা

অঞ্চলভেদে মানুষ যে যে ধরনের খাবারকে প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে থাকে তা দিয়ে ফিতরা দেওয়া যায়। তা হতে পারে খেজুর, কিসমিস, পনির, গম, ভুট্টা, চাল, সীমের বিচি, ডাল, ছোলা, ফূল (একজাতীয় ডাল), নূডুলস, গোশত ইত্যাদি।

নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিতরা হিসেবে এক সা’ খাবার দেওয়াকে আবশ্যক করেছেন। যেসব খাবার সাহাবিদের প্রধান খাদ্য ছিল তাঁরা তা দিয়ে ফিতরা আদায় করতেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)

হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমরা নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময় ঈদের দিন এক সা’ খাদ্যদ্রব্য (ফিতরা) হিসেবে প্রদান করতাম। তিনি আরও বলেন, ‘তখন আমাদের খাদ্য ছিল- যব, কিসমিস, পনির ও খেজুর।’

অন্য এক বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘যখন আমাদের মাঝে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন তখন আমরা ছোট-বড়, স্বাধীন-ক্রীতদাস সবার পক্ষ থেকে জাকাতুল ফিতর (ফিতরা) হিসেবে এক সা খাদ্য কিংবা এক সা’ পনির কিংবা এক সা’ যব কিংবা এক সা’ খেজুর কিংবা এক সা’ কিসমিস আদায় করতাম।’

ফিতরার পরিমাণ

হাদিসের বর্ণনায় ফিতরার সাদকা হচ্ছে- ‘এক সা’। এখানে ‘সা’ বলতে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময় মদিনায় প্রচলিত ‘সা’ উদ্দেশ্য। পৃথিবীর অন্য কোথাও যদি ‘সা’ এর হিসাব প্রচলিত থাকে আর তা যদি নবিজী ঘোষিত ‘সা’ এর বিপরীত হয়; তবে তা গ্রহণযোগ্য নয়। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষিত ‘সা’ অনুযায়ী বর্তমান সময়ের ওজন বা পরিমাপ হলো- ২ কেজি ৪০ গ্রাম।

ফিতরা দেওয়ার সময়

ফিতরার খাদ্য ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগেই বণ্টন করা ওয়াজিব। ঈদের  নামাজের পর পর্যন্ত দেরি করা বৈধ নয়। বরং ঈদের এক বা দুই দিন আগে আদায় করে দেওয়াই উত্তম।

ইসলামিক স্কলারদের বিশুদ্ধ মতানুযায়ী ফিতরা আদায় করার সময় শুরু হয় ২৮ শে রমজান। কারণ রমজান মাস ২৯ দিনও হতে পারে। আবার ৩০ দিনও হতে পারে। রাসুলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবাগণ ঈদের একদিন বা দুই দিন আগে ফিতরা আদায় করতেন।

ফিতরা পাবেন যারা

ফিতরা দেওয়ার খাত হচ্ছে- ফকির ও মিসকিন। আবার অনেক ইসলামিক স্কলাররা বলেছেন, সবাই যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী ফিতরা আদায় করবে। কারণ ফিতরা দেওয়ার মাধ্যমে রোজাদারের রোজার দোষ-ত্রুটিগুলো মার্জনাকারী। হাদিসে এসেছে-

হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণনা করেছেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনর্থক কাজ ও অশ্লীলতা থেকে পবিত্রকরণ এবং মিসকিনদের জন্য খাদ্যের উৎস হিসেবে রোজা পালনকারীর উপর ফিতরা ফরজ করেছেন। যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের আগে তা আদায় করবে তা কবুলযোগ্য ফিতরা হিসেবে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের পর আদায় করবে সেটা সাধারণ সাদকা হিসেবে গণ্য হবে।’ (আবু দাউদ)

ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক নির্ধারিত ফিতরা

৯ এপ্রিল (শনিবার) ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সভায় এ বছরের ফিতরার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। তাহলো-

১. গমের বাজার মূল্য অনুযায়ী : ৭৫ টাকা।

২. যবের বাজার মূল্য অনুযায়ী : ৩০০ টাকা।

৩. কিসমিসের বাজার মূল্য অনুযায়ী : ১৪২০ টাকা।

৪. খেজুরের বাজার মূল্য অনুযায়ী : ১৬৫০ টাকা।

৫. পনিরের বাজার মূল্য অনুযায়ী : ২৩১০ টাকা।

সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, সর্বোচ্চ পরিমাণ ২৩১০ টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় করা। তাতে সামর্থ্য না হলে যার যার অবস্থা অনুযায়ী পণ্যের সমপরিমাণ অর্থ দিয়ে ফিতরা আদায় করা। একান্তই যাদের সামর্থ্য নেই, তাদের জনপ্রতি ৭৫ টাকা দিয়ে ফিতরা করা।

ফিতরা আদায়ের উপকারিতা

১. এই সাদকাহ হবে রোজার ভুল-ত্রুটির ঘাটতির পরিপূরক। কেননা সওয়াবের কাজ-কর্ম মানুষের পাপ তথা গুনাহকে ধ্বংস করে দেয়।

২. এ সাদকাহকে আবশ্যক করার আরেকটি কারণ হচ্ছে- ঈদের দিন গরিব ও মিসকিনদের আনন্দ-বিনোদন, উত্তম পোশাক ও খাবারের সহজলভ্যতার জন্য। যাতে তারাও ধনীদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে। হাদিসে এসেছে-

হজরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিমদের স্বাধীন ও ক্রীতদাস পুরুষ ও নারী এবং ছোট ও বড় সবার জন্য এক সা’ (প্রায় ২ কেজি ৪০ গ্রাম) খেজুর বা যব খাদ্য (আদায়) ফরজ করেছেন। (বুখারি, মুসলিম)

হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জামানায় এর জমানায় আমরা সাদকাতুল ফিতর দিতাম এক সা (সাড়ে তিন কেজি প্রায়) খাদ্যবস্তু, তিনি বলেন, তখন আমাদের খাদ্য ছিল: যব, কিসমিস, পনির ও খেজুর। (বুখারি)

তিনি আরও বলেন, আমরা সাদকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক সা খাদ্যবস্তু। যেমন- এক সা যব, এক সা খেজুর, এক সা পনির, এক সা কিশমিশ। (বুখারি)

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দীর্ঘ একটি বছর মুমিন মুসলমানকে সুস্থ্য ও নিরাপদ রাখার পর বরকতময় মাস রমজান দান করেছেন। তাই এ সুস্থ্য দেহের জাকাত হল ফিতরা।

এই সাদকাহ আদায় করতে হয় আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্য। কেননা আল্লাহ মেহেরবানী করে তার বান্দাদের দীর্ঘ এক মাস মহামূল্যবান ফরজ ইবাদত রোজা রাখার তাওফিক দান করেছেন।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে যথাযথভাবে ফিতরা আদায় করার তাওফিক দান করুন। ফিতরা দেওয়ার ক্ষেত্রে হাদিসের ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com