২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ২৪ শতাংশই পথচারী

0

বিদায়ী ২০২১ সালে সারা দেশে ৫ হাজার ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৬৮ জন। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে মোটরসাইকেলে। এ যানে দুর্ঘটনা ঘটেছে ২ হাজার ৭৮টি, নিহত হয়েছেন ২ হাজার ২১৪ জন। যা মোট দুর্ঘটনার ৩৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। মোট সড়ক দুর্ঘটনার সাপেক্ষে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ।

অন্যদিকে এসব দুর্ঘটনায় এক হাজার ৫২৩ জন পথচারী নিহত হয়েছেন। যা মোট নিহতের ২৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। দুর্ঘটনায় যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৭৯৮ জন, অর্থাৎ ১২ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

বুধবার (৮ জানুয়ারি) সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। সারা বছরে বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে প্রতিবেদনটি তৈরি করে সংগঠনটি।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় যে পরিমাণ মানব সম্পদের ক্ষতি হয়েছে তার আর্থিক মূল্য ৯ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা, যা জিডিপির শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ।

সংগঠনটি জানায়, দুর্ঘটনায় যে পরিমাণ যানবাহন বা প্রপার্টি ড্যামেজ হয়েছে তার তথ্য না পাওয়ার কারণে আর্থিক পরিমাপ নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। সংগঠনটির মতে, দুর্ঘটনার অনেক তথ্য আন্ডার রিপোর্টেড থাকে। ধারণা করা হয়, গণমাধ্যমে যে পরিমাণ তথ্য প্রকাশিত হয়, প্রকৃত তথ্য তার চেয়ে চার থেকে পাঁচগুণ বেশি। এই হিসেবে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আমাদের জিডিপির প্রায় এক দশমিক ৫ শতাংশ হতে পারে।

২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ২৪ শতাংশই পথচারী

রাস্তায় হাঁটার সময় ৫৩ দশমিক ৫১ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে। রাস্তা পারাপারের সময় ঘটেছে ৪৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ দুর্ঘটনা। এছাড়া ৬১ দশমিক ৮০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে যানবাহনের বেপরোয়া গতির কারণে। ৩৮ দশমিক ১৯ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে পথচারীর অসতর্কতার কারণে।

এসব দুর্ঘটনায় পথচারী নিহতের ঘটনা মহাসড়কে ৩০ দশমিক ৯০ শতাংশ, আঞ্চলিক সড়কে ২৩ দশমিক ৮ শতাংশ, গ্রামীণ সড়কে ২৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ ও শহরের সড়কে ১৪ দশমিক ৩২ শতাংশ।

দুর্ঘটনায় পথচারী নিহতের ঘটনা ভোরে ৩ শতাংশ, সকালে ২৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ, দুপুরে ২০ দশমিক ১০ শতাংশ, বিকেলে ২২ দশমিক ১১ শতাংশ, সন্ধ্যায় ১১ দশমিক ৫৫ শতাংশ এবং রাতে ১৪ দশমিক ৮২ শতাংশ ঘটেছে।

২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ২৪ শতাংশই পথচারী

যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী নিহত হয়েছেন দুই হাজার ২১৪ জন। এছাড়া বাসযাত্রী ৩৮৯ জন, ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি যাত্রী ৪৫৭ জন, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-অ্যাম্বুলেন্স-জিপ যাত্রী ২৭৬ জন, থ্রি-হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-মিশুক-টেম্পু-লেগুনা) ৯৩৪ জন, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-পাখিভ্যান-চাঁন্দের গাড়ি-বোরাক-মাহিন্দ্র-টমটম) ৩৫৯ জন এবং বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান-ঠ্যালাগাড়ি আরোহী ১৩২ জন নিহত হয়েছে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, যানবাহনের অতিরিক্ত গতি, সড়কের সাইন-মার্কিং-জেব্রা ক্রসিং চালক এবং পথচারীদের না মানার প্রবণতা, যথাস্থানে সঠিকভাবে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ না করা সহ নানা কারণে পথচারীরা সড়কে মারা যাচ্ছেন। তিনি বলেন, রাস্তায় হাঁটা ও পারাপারের সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা, হেডফোনে গান শোনা, চ্যাটিং করা এবং সড়ক ঘেঁষে বসতবাড়ি নির্মাণ ও সড়কের উপরে হাট-বাজার গড়ে তোলা ইত্যাদি কারণে পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে।

২০২১ সালে ৭৬টি নৌ-দুর্ঘটনায় ১৫৯ জন নিহত, ১৯২ জন আহত এবং ৪৭ জন নিখোঁজ রয়েছেন। ১২৩টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১৪৭ জন নিহত এবং ৩৯ জন আহত হয়েছেন।

২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ২৪ শতাংশই পথচারী

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে দুই হাজার ১৪টি জাতীয় মহাসড়কে, এক হাজার ৬৭০টি আঞ্চলিক সড়কে, ৯৫৪টি গ্রামীণ সড়কে, ৬৬৫টি শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ৬৮টি দুর্ঘটনা ঘটেছে।

এসব দুর্ঘটনার মধ্যে এক হাজার ৫৭টি মুখোমুখি সংঘর্ষ, এক হাজার ৮১৩টি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, এক হাজার ৫৬৬টি পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেওয়া, ৮২২টি যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ১১৩টি অন্যান্য কারণে ঘটেছে।

সংগঠনটি জানায়, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে। এ সময়ে প্রাণহানি বেড়েছে ৪ দশমিক ২২ শতাংশ, আহত বেড়েছে ৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আর ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এ সময়ে প্রাণহানি বেড়েছে ১৫ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং আহত বেড়েছে এক দশমিক ২০ শতাংশ।

২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ২৪ শতাংশই পথচারী

এতে আরও জানানো হয়, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। এতে প্রাণহানি বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৮১ শতাংশ। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫০ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৫১ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, মোটরসাইকেল চালকদের বিরাট অংশ কিশোর ও যুবক। এদের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা এবং না মানার বিষয়টি প্রবল। কিশোর-যুবকরা বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালিয়ে নিজেরা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং অন্যদেরকে আক্রান্ত করছে।

বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, চার চাকার যানবাহনের তুলনায় মোটরসাইকেল ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু দেশে গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত ও সহজলভ্য না হওয়া এবং যানজটের কারণে মানুষ মোটরসাইকেল ব্যবহারে উৎসাহিত হচ্ছে এবং দুর্ঘটনা বাড়ছে।

বক্তারা বলেন, রাজধানীতে যানবাহনের চাপায়-ধাক্কায় পথচারী বেশি হতাহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনা রাতে এবং ভোরে বেশি ঘটেছে। বাইপাস রোড না থাকার কারণে রাত ১০টা থেকে ভোর পর্যন্ত রাজধানীতে মালবাহী ভারী যানবাহন বেপরোয়া গতিতে চলাচল করে। রাস্তা পারাপারে পথচারীরা নিহত হচ্ছেন। এছাড়া দীর্ঘ সময় যানজটের কারণে যানবাহন চালকদের আচরণে অসহিষ্ণুতা ও ধৈর্যহানি ঘটছে, যা সড়ক দুর্ঘটনার পরোক্ষ কারণ হিসেবে কাজ করছে। ফলে সকালে কর্মস্থলে যাবার সময় বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com