রাজধানী ঢাকা দিনকে দিন চলাচল ও বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে!

0

রাজধানী ঢাকা দিনকে দিন চলাচল ও বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। এর প্রধান কারণ হলো যানজট। এর প্রতিকারে সরকার নানা রকম উদ্যোগ নিলেও তা নিরসনের কোনো আপাত সম্ভাবনা নেই। এর কারণ হলো, ঢাকা শহর গড়ে উঠেছে মূলত অপরিকল্পিতভাবে। রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে বসতবাড়ি পর্যন্ত সবকিছুতেই পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে একটি পরিকল্পিত শহরের ২৫ শতাংশ জমি যান চলাচলের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়। সেই হিসাবে ঢাকা শহরের আয়তনের মাত্র সাত শতাংশ যান চলাচলের জন্য ব্যবহার করা হয়, যা প্রকৃত মানদণ্ডের মাত্র ২৮ শতাংশ। এ অবস্থার আশু সমাধানের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কেননা, সড়কগুলোকে প্রশস্ত করার কোনো সুযোগ নেই, নেই নতুন করে রাস্তা নির্মাণের অবকাশ। বরং বিভিন্ন ধরনের দখলদারি, অবৈধ পার্কিং ও রাস্তার ওপর নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখার কারণে রাস্তাগুলো ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে।

ঢাকার সড়কগুলোতে সক্ষমতা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো অতিরিক্ত যানবাহন। বিদ্যমান সড়ক ব্যবস্থা যেখানে চার লাখ যান চলাচলের উপযোগী, সেখানে চলাচল করছে প্রায় ১৭ লাখ যানবাহন। যানবাহনের এ বৃদ্ধির হার দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। গত এক দশক আগে ঢাকায় যান চলাচলের সংখ্যা ছিল ছয় লাখের মতো। ১০ বছরে নতুন ১১ লাখ বাহন যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ ঢাকা শহরে চলাচলকারী যানবাহনের প্রায় ৬৫ শতাংশই যুক্ত হয়েছে গত ১০ বছরে। এর মধ্যে আছে বাস, ট্রাক, ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল, অটোরিকশা, মাইক্রোবাস, ট্যাক্সিক্যাব ও অ্যাম্বুলেন্স। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্ট পর্যন্ত ঢাকায় নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ৩৩ হাজার ১৯৩। এর মধ্যে বাস রয়েছে ৩৭ হাজার ৫১টি, ট্রাক ৭৬ হাজার ৮০৬টি, ব্যক্তিগত গাড়ি ৩ লাখ ১০ হাজার ৪৭৭টি, মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হয়েছে ৮ লাখ ৬২ হাজার ৭৫৪টি, মাইক্রোবাস ৮২ হাজার ৮৮৭টি, ট্যাক্সিক্যাব ৩ হাজার ১৩৬টি, অ্যাম্বুলেন্স ৫ হাজার ৫৭টি এবং অটোরিকশা ২০ হাজার ৬২৯টি।

এই বিপুলসংখ্যক যানবাহন চলাচলের জন্য রয়েছে মাত্র ৩৬০ কিলোমিটার সড়ক। এর মধ্যে দুই সিটি করপোরেশন মিলে প্রাইমারি সড়ক আছে ২০০ কিলোমিটার, সেকেন্ডারি সড়কের পরিমাণ ১১০ কিলোমিটার আর ফিডার রোড আছে ৫০ কিলোমিটার। এ সড়কগুলোতে মোট যাত্রীর মাত্র ১২ শতাংশ চলাচল করে ব্যক্তিগত গাড়িতে; অথচ ব্যক্তিগত গাড়ির দখলে থাকে মোট সড়কের ৫০ শতাংশ। বাদবাকি ৫০ শতাংশ সড়কে চলাচল করে ৮৮ শতাংশ মানুষ। এর বাইরে দুই সিটি করপোরেশনের আওতায় আরও দুই হাজার কিলোমিটার সড়ক আছে, যেগুলোতে অযান্ত্রিক বাহনই বেশি চলে। ঢাকা পরিবহণ সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) বলছে, ঢাকার সব সড়কে ‘পিক আওয়ারে’ ধারণক্ষমতার চেয়ে ২০ শতাংশেরও বেশি যানবাহন চলাচল করে। আর ইন্টারসেকশনগুলোতে চলাচল করছে সক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণ বেশি যানবাহন। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ। ইন্টারসেকশনগুলোতে চারগুণেরও বেশি গাড়ি চলাচল করছে-যে কারণে ফ্লাইওভার, ওভারপাসের মতো বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও যানজটের সুরাহা করা যাচ্ছে না। সড়কগুলোতে যানবাহনের গতি এখন মানুষের হাঁটার গতির চেয়েও কমে গেছে।

শুরুতেই বলেছি, ঢাকার সড়কগুলোতে সক্ষমতার চেয়ে চারগুণেরও বেশি যানবাহন চলাচল করে। এ সক্ষমতাকে আরও বেশি কমিয়ে দিয়েছে অব্যবস্থাপনা। সড়কের অব্যবস্থাপনার মধ্যে রয়েছে অবৈধ দখল, অবৈধ পার্কিং, অবৈধ বাজার, যত্রতত্র নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখা ইত্যাদি। সড়কের এ অব্যবস্থাপনার ওপর গবেষণা করেছে বুয়েট। সেখানে যে চিত্রটি পাওয়া গেছে তা হলো, এ অব্যবস্থাপনার ফলে ঢাকার আউটার সার্কুলার রোডের সক্ষমতা কমে গেছে প্রায় ২৪ শতাংশ, তোপখানা রোডের সক্ষমতা কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। অব্যস্থাপনার কারণে মতিঝিলের সড়কের সক্ষমতা কমে গেছে ২৫ শতাংশেরও বেশি, পান্থপথের কমেছে ১২ শতাংশেরও বেশি, গ্রিন রোডের কমেছে প্রায় ১২ শতাংশ এবং কাঁটাবন সড়কের প্রায় ৭ শতাংশ। তাই বলা যায়, ঢাকাবাসীর দুর্ভোগ এখন চরমে।

ঢাকায় দিন দিন যান চলাচলের রাস্তা আরও সংকুচিত হয়ে আসছে। যাত্রীবাহী বাস, ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, অ্যাম্বুলেন্স, রিকশা, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল, মালবাহী ভ্যান, কাভার্ড ভ্যান, ঠেলাগাড়ি ও ট্রাক একই সময়ে একই রাস্তা দিয়ে প্রতিনিয়ত চলাচল করছে। এগুলোর জন্য নেই আলাদা লেন ব্যবস্থা। একই সড়কে বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের অবাধ চলাচলে ঢাকার রাস্তায় অনিয়ন্ত্রিত যানজটের ধকল পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। একদিকে প্রয়োজনের তুলনায় রাস্তা কম, অন্যদিকে একই রাস্তায় দ্রুতগতির ও ধীরগতির পরিবহণ চলাচল করছে। এ ছাড়া শহরের মধ্যে রেলক্রসিং, ভিআইপি মুভমেন্ট, পার্কিং, ট্রাফিক সিস্টেম এবং সড়ক অব্যবস্থাপনার কারণেও ঢাকার যানজট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। সেই সঙ্গে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতায় সড়কে অব্যাহত খোঁড়াখুঁড়ি দুর্ভোগে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

যানজটের এ বিড়ম্বনার ফলে আমরা একাধিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। প্রথমত, যানজটের কারণে নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টা। আট ঘণ্টার কর্মসম্পাদনের জন্য যাতায়াতেই ব্যয় হয় চার ঘণ্টা। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বলছে, পিক আওয়ারে ঢাকায় গাড়ির গতিবেগ থাকে গড়ে মাত্র ৯ কিলোমিটার। এ নিুগতির কারণে একজন মানুষের প্রতিবার যাতায়াতে যে সময় নষ্ট হয়, তার আর্থিক মূল্য ৫৩ টাকা। ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাংকও একটি হিসাব দেখিয়েছিল। তাতে বলা হয়েছে, ঢাকার যানজটের কারণে বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২৪ থেকে ৪২ হাজার কোটি টাকা। দ্বিতীয়ত, যানজটের কারণে জ্বালানি খরচ বেড়ে যায়। কোনো কোনো জরিপ বলছে, এ বৃদ্ধির পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি। তৃতীয়ত, দীর্ঘক্ষণ ধরে গাড়ির ইঞ্জিন সচল থাকায় তা বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, পরিবেশের জন্য প্রতিকূলতা সৃষ্টি করে। চতুর্থত, যানজটের কারণে শিশুরাও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্কুলে যাতায়াতে অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ তাদের খেলাধুলা ও বিনোদনের সময় নষ্ট করে, যা শিশুদের মানসিক বিকাশের অন্তরায়। পঞ্চমত, এ ধরনের যানজটের বিড়ম্বনা বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের পরিপন্থি এবং প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করছে। সব মিলিয়ে আমরা একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি বলেই প্রতীয়মান হয়।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com