গডফাদারদের ধরা হচ্ছে না, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, এবং দৃশ্যমান শাস্তির অভাবে বাড়ছে দুর্নীতি

0

দেশে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের দৃশ্যমান কঠোর শাস্তি হয় না। রাজনীতিকে টাকা বানানোর হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। দুদকসহ (দুর্নীতি দমন কমিশন) রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকটা নিষ্ক্রিয়। অনিয়মের তথ্য প্রকাশের পর অনেক ক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হতে হয়। রাঘববোয়ালদের ধরা হয় না। যে কারণে দুর্নীতি বাড়ছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি আইনের কার্যকর প্রয়োগ বাড়াতে হবে।

টিআইর রিপোর্ট নিয়ে আলাপকালে দেশের বিশিষ্টজনরা এসব কথা বলেন।

সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশাল (টিআই)। এতে বলা হয়েছে, ১৮০টি দেশের মধ্যে ২০২০ সালে বাংলাদেশে দুর্নীতি ২ ধাপ বেড়েছে। দুর্নীতির সূচকে ২০১৯ সালে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪ নম্বরে। ২০২০ সালে তা ১২ নম্বরে উঠে এসেছে। দুর্নীতির পরিস্থিতি উন্নয়নসংক্রান্ত স্কোরে ১০০ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ২৬। বাংলাদেশের এ অবস্থান এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চতুর্থ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয়।

এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দেশে দুর্নীতি কমার কোনো কারণ নেই, কমানোর প্রচেষ্টাও নেই। তিনি বলেন, দুর্নীতি রোধ সংক্রান্ত আইনকানুন এবং পদ্ধতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। গডফাদারদের ধরা হচ্ছে না। দু-একজন চুনোপুঁটি ধরে দুর্নীতি কমানো সম্ভব নয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম  বলেন, দেশে দুই জায়গায় দুর্নীতি বেশি হয়। প্রথমত সরকারি ব্যয়ে এবং দ্বিতীয়ত ব্যাংকের ঋণ নিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি ব্যয় অনেক বেড়েছে। এছাড়া ঘুষ না দিলে ঋণ পাওয়া যায় না। যে কারণে দুর্নীতি বেড়েছে। তিনি বলেন, যেভাবে দুর্নীতি চিহ্নিত ও শাস্তি হচ্ছে তা আশাপ্রদ নয়। এগুলো দুর্নীতি প্রতিরোধ করার মতো পর্যায়ে এখনও পৌঁছায়নি। তিনি বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এগুলো প্রতিরোধ খুব সহজ ব্যাপার নয়। তবে এক্ষেত্রে সবার আগে সচেতনতা বাড়াতে হবে। মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমি ঘুষ দেব না। দ্বিতীয়ত, সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এর সঙ্গে জড়িতদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। তৃতীয়ত, আইনের ব্যবহার বাড়াতে হবে। এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ অনুসন্ধান এবং দৃশ্যমান শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতির সূচকে আমাদের খারাপ অবস্থানের সবচেয়ে বড় কারণ হলো এটা বন্ধে যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, তার সঠিক প্রয়োগ নেই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ। এর সঠিক বাস্তবায়ন নেই। দ্বিতীয়ত, রাজনীতির সঙ্গে দুর্বৃত্তায়ন এবং কালো টাকার যোগসাজশ রয়েছে। এর সঙ্গে যারা জড়িত সত্যিকার অর্থে তাদের বিচারের আওতায় আনা হয় না। দুদক কিছুটা কাজ করছে, তবে তা একটি সীমারেখার মধ্যে। সেখানে শুধু চুনোপুঁটিদের ধরা হয়। রাঘববোয়ালরা এর বাইরে থেকে যায়। পাশাপাশি দুর্নীতির তথ্য প্রকাশে চাপ রয়েছে। এসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষজনকে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় মামলা হয়েছে। করোনা মোকাবিলায় যে দুর্নীতি হয়েছে, সেটা সবাই জানে। তবে তিনি বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে এটা রোধে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে নিয়ন্ত্রণের পর্যায়ে আসেনি।

জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান বলেন, তিন কারণে দুর্নীতি বাড়ে। প্রথমত, বিবেকের অনুশাসনের অভাব, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ফাঁকফোকর এবং সামাজিক প্রতিরোধের অভাব। তিনি বলেন, রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের কারণে দুর্নীতি কমে না। কারণ রাজনীতিবিদরা সুযোগ করে দিচ্ছেন। ফলে এটা কমাতে সবার আগে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি। তিনি বলেন, সবকিছুতে দলীয়করণ হচ্ছে। পাপুল এবং হাজি সেলিমের মতো লোকজন সংসদ সদস্য হচ্ছেন। তা হলে কীভাবে দুর্নীতি কমবে।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এক ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি করে দুর্নীতিবাজদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি অস্বীকার করা হয়। কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করলে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকর্মীদের নাজেহাল হতে হয়। এতে দুর্নীতিবাজরা উৎসাহিত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে আরও কয়েকটি কারণে এগুলো কমানো যাচ্ছে না। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- রাজনীতিবিদদের প্রতিশ্রুতির ঘাটতি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবহিদিতার অভাব ও রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য অবস্থান সংকুচিত করে দেয়া এবং গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের কথা বলার সুযোগ সীমিত করে দেয়া। তিনি বলেন, আর্থিক খাতে একের পর এক কেলেঙ্কারি ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটলেও তাদের বিচারের আওতায় আনার দৃষ্টান্ত নেই। বিচারিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক আনুগত্যের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করার পরামর্শ দেন তিনি। ড. জামান আরও বলেন, বাংলাদেশের স্কোর অপরিবর্তিত।

টিআইর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্নীতির পরিস্থিতি উন্নয়ণসংক্রান্ত স্কোরে ১০০ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ২৬। এক্ষেত্রে গত ৩ বছর পর্যন্ত একই অবস্থানে। কিন্তু বিশ্বের সব দেশের গড় স্কোর ৪৩। বিশ্বের গড় স্কোরের চেয়ে ১৭ ধাপ পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে আফগানিস্তানের পরেই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। এছাড়াও এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com