শহীদ জিয়া এক মহান নেতা

0

বাংলাদেশের জননন্দিত মহান নেতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, রণক্ষেত্রের বীর সেনানী, সেক্টর কমান্ডার এবং জেড ফোর্সের প্রধান ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ নামে বর্বরোচিত আক্রমণ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতারের পর বাঙালি জাতির জীবনে এক চরম ক্রান্তিকাল উপস্থিত হয়। সেই ক্রান্তিলগ্নে সেনা কর্মকর্তা মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ‘We revolt’ বলে বিদ্রোহ এবং পকিস্তান বাহিনীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। শুধু তাই নয়, তিনি চট্টগ্রাম কালুরঘাটে স্থাপিত অস্থায়ী বেতারকেন্দ্র থেকে প্রথমে নিজ নামে এবং পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নিজের অক্ষয় স্থান নিশ্চিত করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ‘বীর উত্তম’ খেতাব অর্জন করেছিলেন।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এ মাটির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান। সৈনিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু হয়েছিল জিয়ার তাঁর রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্ফূরণ ঘটে ১৯৭৫ সালে। এ বছরের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্ট, ক্রমবর্ধমান অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান যুগপৎভাবে সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম পদত্যাগ করলে জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির দায়িত্বও গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালের ৩ জুন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম দলীয় ভিত্তিতে ও প্রত্যক্ষ ভোটে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন জিয়া। এভাবেই একজন সমর নেতা থেকে জিয়াউর রহমান একজন রাজনীতিবিদ জননেতায় রূপান্তরিত হয়েছিলেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ জিয়াউর রহমানের সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনীতি নতুন পথনির্দেশ লাভ করে।
জিয়াউর রহমান দেশপ্রেমে উজ্জ্বল এক অনুভূতির নাম। বাংলাদেশের ইতিহাসে তার শাসনামল (১৯৭৫-১৯৮১ খ্রি.) সবিশেষ উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার সাফল্য ছিল বহুবিধ। তিনি ছিলেন আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার। তিনি নানা সঙ্কটে বিধ্বস্ত, ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যাপ্রাপ্ত বাংলাদেশকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে অধিষ্ঠিত করে দেশের ইতিহাসে একজন সফল ও মহান রাষ্ট্রনায়কের খ্যাতি লাভ করেছেন। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তক। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। শহীদ জিয়ার উদ্যোগে দেশে পুনরায় বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হয়। ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই রাষ্ট্রপতির জারিকৃত ‘রাজনৈতিক দল-বিধি’ (Political Parties Regulations- PPR)-এর আওতায় ২১টি রাজনৈতিক দল সরকারি নিবন্ধন লাভ করেছিল। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি নিজে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তার প্রতিষ্ঠিত দলটি বর্তমানে বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। জিয়া শুধু বহুদলীয় রাজনীতির পুনপ্রর্বতন করেননি, তিনি বাংলাদেশের গণমাধ্যমের হরণ করে নেয়া স্বাধীনতাও পুনপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ফলে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে যেখানে সরকার নিয়ন্ত্রিত মাত্র চারটি সংবাদপত্র চালু ছিল, তার শাসনামলে এর সংখ্যা দাঁড়ায় কয়েক শ’তে। সাংবাদিকদের জন্য নতুন ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন, প্রশিক্ষণের জন্য প্রেস ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা এবং বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য প্রেস কাউন্সিল গঠন জিয়ারই অবদান।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নকল্পে ব্যাপকভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। সমস্যা জর্জরিত এ দেশে দ্রুত সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন, আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন এবং জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে পল্লী উন্নয়ন, দ্রুততর প্রবৃদ্ধি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ইত্যাদি লক্ষ্যকে সামনে রেখে জিয়া বিখ্যাত ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। দেশে আর্থসামাজিক পরিবর্তন ঘটাতে তিনি দেশের রাজনীতিকে উৎপাদনমুখী রাজনীতিতে রূপান্তরিত করেন। এ লক্ষ্যে তিনি যে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন, সেটিকে তিনি ঘোষণা করেন ‘বিপ্লব’ হিসেবে। ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জিয়া এক ভাষণে এ বিপ্লবের কথা বলেন। তিনি তার ঘোষিত ১৯ দফাকে এ বিপ্লবের কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করেন এবং দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে ঐকান্তিকভাবে কাজ করতে উৎসাহিত করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন কৌশল হিসেবে বেসরকারি খাতকে উৎসাহ দান এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির দ্বার উন্মোচন করেন। বেসরকারি খাতকে উদ্বুদ্ধকরণে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করেন।
জিয়া সরকার জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে বাংলাদেশের ‘এক নম্বর জাতীয় সমস্যা’ হিসেবে ঘোষণা এবং এর নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করে। এ উদ্দেশ্যে প্রথমে ‘জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট’ (NIPORT) এবং পরে ‘পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়’ নামে একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়।
নারীসমাজের অবস্থার উন্নয়ন এবং জনজীবনে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়ন কর্মসূচিতে যুক্ত করার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ হাতে নেয়া হয়। এ লক্ষ্যে মহিলা বিষয়ক একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। জাতীয় মহিলা সংস্থা ও নারী উন্নয়ন একাডেমির তত্ত্বাবধানে নানামুখী প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে নারীদের কর্ম উপযোগী করে তোলা হয়। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২২ শতাংশ, যুবসমাজকে দেশপ্রেম, জাতীয় উন্নয়ন কর্মসূচি ও দায়িত্ববোধে উদ্দীপ্ত করার লক্ষ্য নিয়ে তাদের জন্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় যুবসংস্থা ও গ্রামে যুব কমপ্লেক্স গঠন করা হয়।
দেশের সামগ্রিক উন্নতির জন্য একটি শিক্ষিত মানবসম্পদ গড়ে তোলা শহীদ জিয়ার অন্যতম লক্ষ্য ছিল। স্বনির্ভরতা অর্জনের পরিপূরক হিসেবে গণস্বাক্ষরতা কর্মসূচি চালু করায় স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের প্রায় ৪০ লাখ নিরক্ষর লোককে স্বাক্ষর করা সম্ভব হয়।
একটি বিভাজিত, স্থবির ও হতাশাগ্রস্ত জাতিকে অভিন্ন পরিচয়ে আবদ্ধ করে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জিয়া বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের কথা বলেন। তিনি মনে করতেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন ভাষাভাষী ও ধর্মমতের জাতিগোষ্ঠী বাস করে। তাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার ধরন বিভিন্ন। তাই শুধু ভাষা বা সংস্কৃতির ভিত্তিতে নয়, বরং ভূখণ্ডের ভিত্তিতেই জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করা উচিত। তিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে ধর্ম-বর্ণ-জেন্ডার-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সব নাগরিকের ঐক্য ও সংহতির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। জাতীয়তাবাদের এ ধারণা বাংলাদেশে তৎকালে বিরাজমান কৃত্রিম রাজনৈতিক বিভেদের অবসান ঘটিয়েছিল।
একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে জিয়াউর রহমান পারস্পরিক সমঝোতা ও বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে শান্তি ও অগ্রগতি অর্জনের লক্ষ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ার প্রয়াস নেন। বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করা, দেশের স্বার্থ সুরক্ষা, জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নতি ইত্যাদি উদ্দেশ্যে নতুন পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেন। কোনো বিশেষ পথ-মতের রাষ্ট্রশক্তি নয়, বরং সব পথ-মতের অর্থাৎ দক্ষিণ, মধ্য ও বামপন্থী রাষ্ট্রগুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠাই ছিল জিয়া সরকারের পররাষ্ট্রনীতির বিশেষ দিক। তার সময়ে মুসলিম বিশ্ব, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ও বিদ্যমান সম্পর্কের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে। জিয়ার শাসনামলেই বাংলাদেশ আল কুদসের শীর্ষ কমিটি, ইসলামিক সলিডারিটি কমিটি, ইরাক-ইরান শান্তি কমিটিসহ মুসলিম ও আরব বিশ্ব সংক্রান্ত বিভিন্ন কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করে। তখন বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কার্যক্রমের সাথেও সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হয়। তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণা উদ্ভাবন করেন। ‘দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা’-সার্ক তার চিন্তা ও প্রয়াসের ফসল।
জিয়াউর রহমান ছিলেন সৎ, আদর্শবান ও নিরহঙ্কারী মানুষ। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার সাদাসিধে জীবন-যাপন মানুষের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। জিয়ার প্রতি মানুষের অপার ভালোবাসা, তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আর্থসামাজিক অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের উজ্জ্বল ভাবমর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠা অনেকেরই সহ্য হয়নি। তাই তার বিরুদ্ধে শুরু হয় সুগভীর ষড়যন্ত্র। এর শেষ পরিণতি ১৯৮১ সালের ৩০ মে কতিপয় বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে তার মর্মান্তিক শাহাদাতবরণ।
জিয়া একজন ক্ষণজন্মা ব্যক্তি ও মহান রাষ্ট্রনায়ক। জিয়া বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। জাতীয় ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে একজন পরিত্রাণকারী হিসেবে রাজনীতিতে জিয়ার আবির্ভাব। তিনি শতধা বিভক্ত জাতিকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করেছেন। জিয়া দেশপ্রেমে উজ্জ্বল এক অনুভূতির নাম। ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ, জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ’- ছিল জিয়ার বিশ্বাস ও ধ্যান। তিনি আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার। একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শুধু রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির তার কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেননি, স্বাধীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতেও তার বলিষ্ঠ ভূমিকা ও অবদান রেখে গেছেন। ইতিহাস থেকে কারো অবদান জোর করে মুছে দেয়া যায় না। সাময়িকভাবে আজ জিয়াকে হেয় করা, তার সোনালি অবদানকে অস্বীকার করার অপতৎপরতা আমরা দেখছি। কিন্তু এ অপপ্রয়াস সফল হবে না। জিয়াকে ভুলিয়ে দেয়া, তার অবদানকে মুছে ফেলার সাধ্য এ দেশে কারো হবে না। জিয়া থাকবেন দেশপ্রেমিক বিবেকবান প্রতিটি মানুষের অন্তরে এক জীবন্ত প্রত্যয় হিসেবে।

  • লেখক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com