বিশ্বজুড়ে সরকারি জবরদস্তি কীভাবে মোকাবিলা করছেন সাংবাদিকরা

0

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের মেয়াদ খুব শিগগিরই শেষ হতে যাচ্ছে। কিন্তু ভুয়া খবর নিয়ে তিনি যে ধারণা সৃষ্টি করে গেছেন তা অত দ্রুত মুছে যাবে না। নির্বাচনি প্রচারণার শুরু থেকেই ট্রাম্প সাংবাদিকদের হয়রানি করতে ‘ভুয়া খবর’ (ফেক নিউজ) শব্দ দু’টো ব্যবহার করে আসছেন। উগ্র ডানপন্থি গণমাধ্যমের কারণে সাংবাদিকদের উপর তার ও রিপাবলিকান পার্টির আক্রমণের মাত্রা আরো বেড়েছে। তার প্রশাসন এ হামলা আরো তীব্র করেছে।
এমন পরিবেশে বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকরা কিভাবে কাজ করছেন ও নিজেদের খাপ খাইয়ে নিচ্ছেন তা যাচাই করতে ‘ভুয়া খবর’ প্রচারণা বিদ্যমান রয়েছে এমন চারটি দেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্যান রিপোর্টস।
বেলারুশ
গত গ্রীষ্মের আগে বেলারুশে সাংবাদিকরা পুরোপুরি নিরাপদ ছিল। কিন্তু এরপর দেশটির এক বিতর্কিত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার জি লুকাশেঙ্কো জয়ী ঘোষিত হলে পরিস্থিতি সহিংস মোড় নেয়। সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়। এমনটাই জানান রেডিও ফ্রি ইউরোপের মিনস্ক-ভিত্তিক সাংবাদিক অ্যান্টন ট্রাফিমোভিচ।
গত নির্বাচনে স্বাধীনতার পর থেকে টানা ২৬ বছর ধরে বেলারুশ শাসন করা লুকাশেঙ্কোর প্রতিদ্বন্দ্বী সভেতলানা তিখানভস্কায়া প্রত্যাশার চেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পান।কিন্তু বুথফেরত জরিপে দেখা যায়, ৮০ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হতে যাচ্ছেন লুকাশেঙ্কো। এই ফলাফলের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। তাদের দমাতে পুলিশ ও সামরিক বাহিনী মোতায়েন হয়। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেও দমন অভিযান বাড়ে।
সহিংসতা ও গ্রেপ্তারের ভয় সাংবাদিকদের নতুন পদ্ধতিতে কাজ করতে বাধ্য করেছে। এখন আর তারা সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিতে চান না। গণমাধ্যমগুলো মেসেঞ্জার অ্যাপ টেলিগ্রামের মাধ্যমে কাজ করা শুরু করেছে। সেখানে বেশিরভাগ জনপ্রিয় চ্যানেলগুলো চালান অধিকারকর্মীরা। তবে রেডিও ফ্রি ইউরোপের মতো প্রচলিত গণমাধ্যমগুলোও টেলিগ্রামে তাদের খবরগুলো পোস্ট করে থাকে।
ট্রাফিমোভিচের মতে, সব গণমাধ্যম এখন কেবল টেলিগ্রাম চ্যানেল।
জর্ডান
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সারা কায়্যালি বলেন, জর্ডানে সরকার নিজের স্বার্থে যখন ইচ্ছা বিশেষ আইন ব্যবহার করে সাংবাদিকদের নীপিড়ন করতে পারে।
দেশটিতে এমন আইন আছে যে, রাজা, দেশ ও দেশটির মিত্রদের নিয়ে নেতিবাচক কথা বললেও শাস্তির বিধান রয়েছে। গত আগস্টে জর্ডানের মিত্র ইসরাইলের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শান্তিচুক্তি নিয়ে কার্টুন আঁকায় এক কার্টুনিস্টকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গত বসন্তে করোনা ভাইরাস নিয়ে ‘আতঙ্ক’ ছড়ানোর দায়ে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের নির্বাহীদের গ্রেপ্তার করা হয়।
২০১৫ সাল থেকে জর্ডানে কয়েকদফা সন্ত্রাস-বিরোধী পদক্ষেপ জারি হয়। এরপর থেকে দেশটিতে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে দমন অভিযান ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে গেছে। এতে সাংবাদিকদের মধ্যে সেলফ-সেন্সরশিপ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশটির অনেক সাংবাদিক এখন আর বিতর্কিত বিষয়ে কাজ করতে চান না।
দ্য ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটরের জর্ডান প্রতিনিধি টেইলর লাক বলেন, নতুন বিধিনিষেধের কারণে সূত্রের পরিচয় প্রকাশে সতর্ক হয়ে উঠেছেন তিনি। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার পরিণতি সম্পর্কে সূত্রদের আগ থেকেই স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলেন তিনি। কিন্তু এটা অনেক ক্লান্তিকর ও এতে অনেক সময় লাগে। তাছাড়া, কেবল জর্ডানের বিষয়েই নয়, তাদের মিত্র দেশগুলোর বিষয়ে সংবাদ প্রকাশেও সেন্সরশিপ দেখা যায়।
প্রায় ৩০ বছর ধরে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সাংবাদিক রানা হুসেইনি বলেন, জর্ডানিয়ান সাংবাদিকদের মধ্যে সেল্ফ-সেন্সরশিপের প্রভাব ব্যাপক। তিনি বলেন, আজকাল আমরা অনেক বিষয়েও কম কথা বলি।
সেন্সরশিপের প্রভাবে নিয়মিত রিপোর্টিংয়ের উপর প্রভাব পড়ে। লাক বলেন, এতে পুরো মিডিয়া জগতই পাল্টে গেছে। মানুষজন এখন ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলোয় খবর শেয়ার দেয়। তিনি আরো বলেন, সেন্সরশিপ সরকারের অবস্থান জোরালো করার চেয়ে আরো দুর্বল করে দিচ্ছে। রাষ্ট্র-পরিচালিত গণমাধ্যমগুলো গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।
থাইল্যান্ড
থাইল্যান্ডে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বহু আগ থেকেই কোনঠাসা ছিল। সম্প্রতি তা মারাত্মক আঁকার ধারণ করেছে। দেশটিতে রাজ পরিবার ও নতুন সামরিক শাসনের সমালোচনা বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে রাজতন্ত্রের অপমান নিষিদ্ধ করা কঠোর ‘লেসে-মাজিস্তে’ আইনের আওতায় নিপীড়নও।
অনলাইন সংবাদমাধ্যম ওয়ার্কপয়েন্ট টুডে’র সম্পাদক নোপ্পাতজাক অ্যাটানন বলেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে আমরা আলোচনা করতে পারি না। ২০১৯ সালে সরকার একটি ‘ভুয়া খবর বিরোধী’ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। সেখানে ৩০ জনের মতো কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়, যাদের কাজ হচ্ছে, সরকারবিরোধী অনলাইন কনটেন্ট তৈরিকারী মানুষদের টার্গেট করা। ২০১৪ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকেই নিপীড়নমূলক আইনগুলোর সংখ্যা বেড়েছে।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের গবেষক ড্যানিয়েল বাস্টার্ড বলেন, এসব দমনমূলক পদক্ষেপ নতুন ঘরানার সংবাদমাধ্যম তৈরি করেছে।
ইসাম রেকর্ডের মতো নিউজ সাইটগুলো এখন থাইল্যান্ডের রাজ পরিবারের সমালোচনামূলক আর্টিকেল প্রকাশ করে থাকে। সম্প্রতি সাইটটির সম্পাদক হাথাইরাইত ফাহলতাপ গণতন্ত্রপন্থি অধিকারকর্মী ও আইনজীবী অ্যানন নাম্পার সাক্ষাৎকার নেন। সেখানে অ্যানন বলেন, তিনি রাজতন্ত্রের সংস্কার করতে চান।
ফাহলতাপ পূর্বে থাই পিবিএস-এ কাজ করতেন। তিনি জানান, সেখানে থাকাকালে এমন সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা সম্ভব হতো না তার পক্ষে।
নতুন গণমাধ্যমগুলো দেশটিতে হওয়া বিক্ষোভগুলো নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে আলোচনা করে। গণতন্ত্রপন্থি তরুণরা এসব গণমাধ্যমের নিয়মিত পাঠক। অন্যদিকে বয়স্ক পাঠকরা মূলত টিভিতে প্রচারিত সংবাদ দেখে থাকেন। আর টিভি চ্যানেলগুলো নিয়ন্ত্রণ করে থাকে সরকার।
নিকারাগুয়া
গত শরতে নিকারাগুয়ায় নতুন দুটি আইন পাস হয়। প্রথমটির আওতায়, বিদেশ থেকে অর্থ পাওয়া যেকোনো ব্যক্ত্যিকে বিদেশি এজেন্ট হিসেবে নিবন্ধন করা হবে। দ্বিতীয় আইন অনুসারে, ‘ভুয়া খবর’-কে অপরাধ হিসেবে শনাক্ত করা হয়। এই আইনের অধীনে ‘আতঙ্ক, উৎকণ্ঠা বা ভীতি ছড়ানোর দায়ে’ অপরাধীকে সর্বোচ্চ ছয় বছর কারাদ- দেওয়া যাবে। আগ থেকেই দেশটিতে অনেক সাংবাদিকরা নিপীড়িত হয়ে আসছেন। অনেকে চলে গেছেন নির্বাসনে। এর মধ্যে নতুন আইন দুটি তাদের জীবন কঠিন করে তুলেছে।
২০১৮ সাল থেকে দেশটির দীর্ঘদীনের প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল অর্তেগা ও তার স্ত্রী রোজারিও মুরিলো – দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ডি ফ্যাক্টো প্রেস সেক্রেটারি- তাদের বিরোধী ও সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে দমন অভিযান জোরদার করেছে। নিউজ সাইট কনফিডেনসিয়াল এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক কার্লস চামোরোর ভাষ্যমতে, প্রেসিডেন্ট ও তার স্ত্রীর থা হচ্ছে, ভুয়া খবর কোনটি তা নির্ধারণ করবেন তারাই।

২০১৯ সালে চামোরোর নিউজরুম দখল করে নিয়েছিল পুলিশ। এরপর ওনি নির্বাসনে যান। সম্প্রতি দেশটিতে ফেরত গেছেন। তবে তার মতো নির্বাসনে যাওয়া আরো অনেকে আর ফেরেননি। অর্তেগা সরকারের নিপীড়নের মুখে সাংবাদিকদের কাজের ধরণে পরিবর্তন এসেছে। তারা সহযোগী হয়ে উঠেছেন। এখন আর কেউ একা একা বিক্ষোভ কভার করতে যান না। দলবেঁধে যান। চামোরো বলেন, পুলিশ হয়রানির মুখে কোনো রিপোর্টারের পক্ষেই একা কাজ করা সম্ভব না।

সাংবাদিকদের আশঙ্কা, একা থাকলে তাদের উপর হামলা চালানো হতে পারে। গণমাধ্যম নিয়ে কাজ করা সংগঠন দ্য ভায়োলেতা ব্যারিওস দে চামোরো ফাউন্ডেশন অনুসারে, গত বছর দেশটির সাংবাদিকদের উপর ৭২টি হামলা চালানো হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দলবেঁধে কাজ করাই শ্রেয়। এতে কাজ সম্পন্নও সহজ হয়।
স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে এখন তথ্য বিনিয়মও বেড়েছে। মূলধারার গণমাধ্যমগুলো যেসব বিষয় এড়িয়ে যায় সেগুলো নিয়ে কাজ করে তারা। আর এভাবেই বেশকিছু সাড়া জাগানিয়া সংবাদ প্রকাশ করেছে কনফিডেনসিয়াল।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com