এমন মেয়েকে নিয়ে যে শুধু গর্বই করা যায়

0

বাবা দৃষ্টি প্রতিবন্ধি। পাঁচ সদস্যের এ সংসারটাও যে অভাবের। তাতে কি, জীবন তো আর থেমে থাকে না। সংসারের খরচ, নিজের লেখা-পড়া ও তিনটি এনজিওর কিস্তি সবটাই কাঁদে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী শিশু জুই মনির। বয়স এখন ১০ বছর কিন্তু দায়িত্বটাই যে বড় তার কাছে। শিশু জুই মনি সংসারের হাল ধরতে বেছে নিয়েছেন ব্যাটারিচালিত ভ্যান। যে বয়সে স্কুল আর খেলার মাঠে থাকার কথা মেয়েটির ওই বয়সেই নেমেছেন জীবনযুদ্ধে। এমন মেয়েকে নিয়ে যে শুধু গর্বই করা যায়।

জুই মনির বাড়ি পার্বতীপুর উপজেলার হরিরামপুর ইউনিয়নের আকন্দ পাড়া গ্রামে। জুই দক্ষিণ মধ্যপাড়া কমিউনিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী।

বাবার নাম জিয়াউল হক (৪২)। তিনি জন্ম থেকেই চোখে কম দেখতেন। জঙ্গলের পাতা কুড়িয়েই সংসার চালাতেন জিয়াউল হক। তবে তিন বছর ধরে চোখে কিছুই দেখতে পান না তিনি। অক্ষম হয়ে পড়েছেন স্বাভাবিক চলাচলেও। ফলে তার সংসারে নেমে এসেছে অভাব-অনটন। এরমধ্যেই এলাকাবাসীর সহযোগিতায় বিয়ে দিয়েছেন বড় মেয়ে রোমানা আক্তারকে।

জিয়াউল হক বলেন, তার এ অবস্থায় বিভিন্ন সময় না খেয়েও থাকতে হয়েছে পরিবারের সদস্যদের। এমন অবস্থা দেখে সংসারের হাল ধরেছেন শিশু মেয়ে জুই। ভ্যান চালিয়ে কোনোভাবে চালাচ্ছেন সংসার।

মধ্যপাড়া বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ভ্যান নিয়ে যাত্রীর অপেক্ষায় রয়েছেন জুই মনি।

এ সময় তার সাথে কথা বলতে চাইলে জুই বলেন, গাড়ি ভালোই চালান তিনি। পার্বতীপুর, ফুলবাড়ী ও বদরগঞ্জসহ শহরের বিভিন্ন জায়গায় ভাড়া নিয়ে যান তিনি। এ ভাবেই চলছে তার জীবনযুদ্ধ।

জুই মনিদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বন বিভাগের জায়গায় টিনের ঘর বানিয়েছেন তারা। ওই ঘরেই তাদের বসবাস। তবে নিজেদের নেই এক শতক জমিও, নেই বসতাভিটা।

জুই মনির মা শাহারা বানু বলেন, ‘তিনটি এনজিও থেকে লোন নিয়ে বন বিভাগের জায়গায় এই টিনের ঘর ও ভ্যানগাড়িটি কিনেছেন। সপ্তাহে তিন হাজার সাত শ’ টাকা কিস্তি ও পরিবারে সদস্যদের খরচ সবটাই বহন করছেন মেয়ে জুই। মেয়ের বাবা প্রতিবন্ধী ভাতার টাকা পান এই দিয়ে কোনো রকমে চলে তাদের সংসার।’

তিনি আরো বলেন, ‘জুই ভ্যান চালানোর কারণে প্রথম দিকে গ্রামবাসী তার মেয়েকে নিয়ে অনেক কথা বলতো। মেয়ে হয়ে ভ্যান গাড়ি চালায়, এই মেয়েকে বিয়ে করবে কে, আরো কত কি। তখন খুব খারাপ লাগতো। এ নিয়ে অনেক সময় ঘরে বসে কান্নাও করতেন তিনি। তবে এখন তিনি মেয়ের জন্য গর্ব করেন।’

জুই মনি এই প্রতিবেদকে জানায়, ‘মা-বাবার কষ্ট দেখে খারাপ লাগতো। আমরা চার বোন ও এক ভাই অনেক সময় না খেয়েও থেকেছি। টাকার অভাবে অনেক সময় মুখে খাবার জুটতো না। পরে নিজেই ভ্যান চালানো শুরু করি। ভ্যান চালিয়ে প্রতিদিন ৩০০ থেকে সাড়ে ৪০০ টাকা রোজগার হয়। আমার পড়ালেখা করতে ভালো লাগে। শত কষ্ট হলেও পড়ালেখা শেষ করতে চাই। বাবার কোনো জমি-জমা নেই। বন বিভাগের জায়গায় আমাদের বাড়ি। এক ঘরে আমি ও অন্য ঘরে মা-বাবা ও ছোট বোন থাকে। আমি যা রোজগার করি তা দিয়ে সংসার চলে। পাশাপাশি লেখা-পড়া করছি।’

দক্ষিণ মধ্যপাড়া কমিউনিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘জুই অত্যন্ত নম্র, বিনয়ী ও খুব মিশুক মেয়ে। সে লেখাপড়ার পাশাপাশি ভ্যান চালায়। তবে ছাত্রী হিসেবে ভালো। এই বয়সে সে পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। মেয়ে হয়েও অনেক কিছু করা যায়, তারই দৃষ্টান্ত জুই।’

প্রধান শিক্ষক আরো বলেন, ‘মেয়েটির কাছ থেকে এখনকার ছেলে-মেয়েদের অনেক কিছু শেখার আছে। লেখাপড়া ও খেলাধুলায় সে খুব ভালো। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গিয়েছিলেন জুই মনির বাবা। হাসপাতাল থেকে তিনি জানতে পেরেছেন, তার চোখের জন্য অপারেশন করতে হবে। অনেক টাকা দরকার। মেয়ের আয়ে কোনোমতে সংসার চলে। চিকিৎসার টাকা কোথায় পাবেন, সেটা ভেবেই দুর্বিষহ দিন কাটছে তাদের।

উপজেলার হরিরামপুর ইউনিয়নের আকন্দ পাড়া গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য মো: রাহিনুল হক বলেন, ‘জুইয়ের পরিবারকে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সহযোগিতা করার সাধ্যমতো চেষ্টা করি। তবে সমাজের বৃত্তবানরা যদি এগিয়ে এসে তাদের পাশে দাঁড়ান তবে ওই পরিবারটির অনেক উপকার হবে।’

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com