স্বাধীনতা ও মওলানা ভাসানী: এক সংগ্রামী জীবনের আলেখ্য

0

বিজয়ের মাসে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ভূমিকা প্রসঙ্গে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা দরকার। কারণ স্বায়ত্তশাসনের প্রাথমিক আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে তার ছিল বলিষ্ঠ ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। ‘পশ্চিম পাকিস্তান’কেন্দ্রিক পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ, নির্যাতন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্বায়ত্তশাসনের যে পর্যায়ক্রমিক আন্দোলন ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছিল, মওলানা ভাসানী ছিলেন তার একজন প্রধান নির্মাতা। 

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পর আজকের বাংলাদেশ তথা তৎকালীন ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ প্রতি শোষণ, বঞ্চনা ও অবিচারের সূচনা হলে প্রথমে ব্যক্তিগতভাবে এবং পরবর্তীকালে নিজের নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে গঠিত আওয়ামী (মুসলিম) লীগের মাধ্যমে তিনি স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে ক্রমাগত তীব্রতর করেছিলেন। মওলানা ভাসানী স্বায়ত্তশাসন চাইতেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ভিত্তি ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী— যেখানে ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ মতো প্রতিটি প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্যের জন্য স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি ঘোষিত হয়েছিল।

স্বায়ত্তশাসনের বিকল্প হিসেবে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারণা চালানো ও জনমত সংগঠিত করা ছিল মওলানা ভাসানী পরিচালিত আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। স্বায়ত্তশাসনসহ প্রদেশের বিভিন্ন দাবি সংবলিত ২১ দফার ভিত্তিতে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে মওলানা ভাসানী একজন প্রধান নেতার ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করা সত্ত্বেও মূলত নেতৃত্বের কোন্দলে সেবার স্বায়ত্তশাসন পাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। এ সময় থেকেই মওলানা ভাসানী স্বাধীনতার কথা বলতে শুরু করেছিলেন। ১৯৫৫ সালের ১৭ জুন এবং ১৯৫৬ সালের ৭ ও ১৫ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত তিনটি জনসভায় তিনি ঘোষণা করেছিলেন, স্বায়ত্তশাসন না দেওয়া হলে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ স্বাধীনতার কথা চিন্তা করবে। বলা দরকার, ওই দিনগুলোতে স্বাধীনতার কথা বলা ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ। কিন্তু দুর্দান্ত সাহসী নেতা মওলানা ভাসানী কোনো কিছুকে পরোয়া করেননি।

১৯৫৬ সালের সংবিধানে ‘পূর্ব পাকিস্তান’কে স্বায়ত্তশাসন না দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৭ সালের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন হিসেবে আয়োজিত ‘কাগমারী সম্মেলনে’ মওলানা ভাসানী ‘পশ্চিম পাকিস্তান’কে ‘আসসালামু আলাইকুম’ তথা বিদায় জানানোর এবং ‘পূর্ব পাকিস্তান’কে স্বাধীন করার আগাম ঘোষণা দিয়েছিলেন। বিষয়টি সাধারণ ছিল না। কারণ, মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ তখন কেন্দ্রে ও প্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল। প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি এবং আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ জানানোয় মওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। পরিণতিতে মওলানা ভাসানীকে তাঁর নিজের হাতে গড়া আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল, তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে নতুন একটি দল গঠন করেছিলেন (জুলাই, ১৯৫৭)। এরপর মওলানা ভাসানী ন্যাপের মাধ্যমে তাঁর স্বাধীনতামুখী স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছেন।

১৯৬৯-এর যে গণঅভ্যুত্থান পাকিস্তান সরকারকে স্বায়ত্তশাসন স্বীকার করে নিতে বাধ্য করেছিল, সে গণঅভ্যুত্থানের পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন মওলানা ভাসানী। সেটা এমন এক সময় যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে ছিলেন। (১৯৬৬ সালের মে থেকে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি করা হয়েছিল।) ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে মওলানা ভাসানী ‘ঘেরাও’ নামের এক নতুন ধরনের আন্দোলন শুরু করেছিলেন। ৪ ডিসেম্বর তাঁর নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা গভর্নর হাউস (বর্তমান বঙ্গভবন) ঘেরাও করে। এই ঘেরাও আন্দোলনের পথ ধরেই ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে ঘোষিত হয়েছিল ছাত্র সমাজের ১১ দফা। ১১ দফাভিত্তিক গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতন ঘটেছিল এবং মুক্তি পেয়েছিলেন শেখ মুজিবসহ রাজনৈতিক বন্দিরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন সাময়িককালের জন্য বিভ্রান্ত ও স্তিমিত হয়ে পড়লেও মওলানা ভাসানী পরিস্থিতিকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যখন স্বাধীনতার দাবি এসে গিয়েছিল মানুষের মুখে মুখে। স্বাধীনতামুখী এই অবস্থান থেকে জনগণকে আর কখনো ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। বস্তুত ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ছিল সরাসরি পাকিস্তানবিরোধী সফল অভ্যুত্থান এবং তার প্রধান নির্মাতা ছিলেন মওলানা ভাসানী।

১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলে ১২ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। কিন্তু পাকিস্তান সরকার যথারীতি চরম উপেক্ষা দেখিয়েছে, এদেশের রাজনৈতিক দলগুলোও তখন জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিল। অন্যদিকে মওলানা ভাসানী নিয়েছিলেন দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতার অবস্থান। হাসপাতালের বিছানা থেকে তিনি ছুটে গেছেন উপদ্রুত অঞ্চলে। ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ ভাসানী এরপরই সরাসরি স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক দিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালের ৩০ নভেম্বর এক প্রচারপত্রের মাধ্যমে আহ্বান জানানোর পর ৪ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানের জনসভায় মওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে পবিত্র কোরআনের সুরা ‘কাফেরূন’ থেকে আয়াত উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘লাকুম দীনুকুম ওয়া লিয়া দীন’ (তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম আর আমাদের জন্য আমাদের ধর্ম)। অর্থাৎ তোমার রাস্তায় তুমি যাও, আমাকে আমার রাস্তায় চলতে দাও। এটা ছিল প্রকারান্তরে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা। এর ভিত্তিতেই মওলানা ভাসানীর ন্যাপ ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচন বর্জন করেছিল। প্রমাণিত হয়েছে, ন্যাপ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বলেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের পক্ষে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল।

নির্বাচনের পর ১৯৭১ সালের ৭ জানুয়ারি মওলানা ভাসানী স্বাধীনতা সংগ্রামের পাঁচ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের পন্থা নির্ধারণের জন্য ৯ জানুয়ারি তাঁর উদ্যোগে সন্তোষে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সর্বদলীয় সম্মেলন। এই সম্মেলন থেকে স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছিলেন তিনি। ৩ মার্চ থেকে অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে আরো একবার স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বানমুখে সোচ্চার হয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। ৪ মার্চ এক বিবৃতিতে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার ডাক দিয়েছিলেন। ৯ মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি ২৫ মার্চের মধ্যে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ১৭ মার্চ চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইয়াহিয়ার উচিত এমন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা, যার কাজ হবে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রাপ্য সম্পদ পূর্ব পাকিস্তানকে বুঝিয়ে দেওয়া। নিজের ছেলের মতো শেখ মুজিবের প্রতি আহ্বান জানিয়ে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ইয়াহিয়ার সঙ্গে সমঝোতা বৈঠক করার পরিবর্তে তাঁর উচিত বাংলার সংগ্রামী নেতার ভূমিকা পালন করা। সর্বশেষ এক বিবৃতিতে মওলানা ভাসানী ২৩ মার্চকে ‘লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন— যার অর্থ, ওইদিন থেকে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হবে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যার অভিযান শুরু হয়েছিল, ৩ এপ্রিল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সন্তোষে মওলানা ভাসানীর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তিনি আসামের ফুলবাড়ী হয়ে ১৫ এপ্রিল ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। ভারতবিরোধী পরিচিতি থাকায় ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস সরকার তাঁকে স্বাধীনভাবে তৎপরতা চালাতে দেয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও মওলানা ভাসানী দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে একজন প্রধান দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতার ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিবৃতি ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে তিনি জনগণের প্রতি স্বাধীনতা যুদ্ধ এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানের কাছে বাংলাদেশকে সমর্থন করার ও স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তারবার্তা পাঠিয়েছেন। কলকাতায় গঠিত মুজিবনগর সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো এবং ওই সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেওয়া ছিল মওলানা ভাসানীর বিশেষ অবদান। মুজিবনগর সরকার তাঁকে উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি বানিয়েছিল এবং সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত পরিষদের একমাত্র সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেছিলেন।

এভাবে পর্যালোচনায় দেখা যাবে, স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্ব থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জন পর্যন্ত দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে মওলানা ভাসানী অগ্রবর্তী অবস্থানে থেকেছেন। সরকারের নির্যাতন, দলের ভাঙন ও সহকর্মীদের পক্ষত্যাগের মতো কোনো বাধা বা প্রতিকূলতাই তাঁকে স্বাধীনতার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। স্বাধীনতার পরও তাঁর সে দেশপ্রেমিক ভূমিকা অব্যাহত ছিল। মওলানা ভাসানী শুধু দেশ ও জাতির স্বার্থে আজীবন সংগ্রাম করে যাননি, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবেরও নেতা ছিলেন। জীবনের শেষ দিনগুলোতেও দুজনের সম্পর্ক ছিল পিতা-পুত্রের মতো। দেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে মওলানা ভাসানীকে যথাযথ সম্মান দেখিয়েছেন, পরামর্শের জন্য হাজির হয়েছেন সন্তোষে। রাজনৈতিক বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও মওলানা ভাসানীও তাঁকে পরামর্শ দিয়েছেন। সহযোগিতা করেছেন। এভাবেই একজন প্রধান জাতীয় নেতার ভূমিকা পালন করে গেছেন মওলানা ভাসানী। [লিখা: পুনঃমুদ্রিত]

লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com