ওয়াইসিকে নিয়ে ভারতীয় মুসলিমরা কেন নতুন স্বপ্ন দেখছে?

0

“আমার ইতিহাস মানুষ জানে না। বারো-তেরো বছর বয়স থেকে শুনছি আমাদের বাড়ির সামনে এসে আরএসএস গুন্ডারা নোংরা স্লোগান দিচ্ছে, ওয়াইসি কবরে যাও কিংবা পাকিস্তানে।”

ভারতের হায়দ্রাবাদ-ভিত্তিক রাজনৈতিক দল মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (এআইএমআইএম) বিহারের নির্বাচনে অভাবিত সাফল্য পাওয়ার পর ওই দলের নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসির বিরুদ্ধে আবার বিজেপিকে সুবিধা করে দেওয়ার অভিযোগ তোলা হচ্ছে।

কংগ্রেসের নেতারা সরাসরি বলছেন, ওয়াইসির দল মুসলিম ভোট কেটেছে বলেই বিজেপি জোট বিহারে আবার ক্ষমতায় আসতে পারল।

আসাদউদ্দিন ওয়াইসি বিবিসির কাছে এই অভিযোগ অবশ্য জোরালোভাবে অস্বীকার করেছেন – এবং বলছেন ভারতীয় মুসলিমরা তাকে বিজেপির ”উপযুক্ত জবাব” হিসেবে দেখছেন বলেই বিভিন্ন রাজ্যে বেছে নিচ্ছেন।

মহারাষ্ট্র ও বিহারের পর তার পরবর্তী নিশানা যে পশ্চিমবঙ্গ, সেটাও তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন।

তিন তালাক রদ করার বিরোধিতা থেকে শুরু করে বাবরি মসজিদ ভাঙার ইস্যু বা নাগরিকত্ব আইন নিয়ে ওয়াইসি যেভাবে সরব হয়েছেন, তাতে ভারতীয় মুসলিম সমাজের একটা বড় অংশ তাকে সেদেশে মুসলিমদের ”নতুন নেতা”র ভূমিকায় দেখতে শুরু করছেন।

বস্তুত প্রায় ৯৩ বছরের পুরনো রাজনৈতিক দল মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের প্রভাব মাত্র বছরকয়েক আগেও হায়দ্রাবাদ শহরের গন্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

কিন্তু এখন মহারাষ্ট্র থেকেও তাদের নির্বাচিত এমপি ও এমএলএ-রা আছেন, গত রাতে বিহার বিধানসভাতেও তাদের নতুন পাঁচজন বিধায়ক যুক্ত হলেন।

দলনেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি যেভাবে দেশের নতুন নতুন প্রান্তে জমি খুঁজে পাচ্ছেন তাতে তাকে ভারতীয় মুসলিম সমাজের উদীয়মান মুখ হিসেবে অনেকে দেখছেন ঠিকই – কিন্তু কংগ্রেস তাকে দিচ্ছে ”ভোট-কাটুয়া”র তকমা।

হায়দ্রাবাদের রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক শাহিদ মিও বিবিসিকে বলছিলেন, “এটা ঠিকই যে ওয়াইসি খুব দ্রুত উঠে আসছেন ও মানুষ তাকে নানা জায়গায় গ্রহণও করছে, তবে তাকে নিয়ে নানা বিপরীতমুখী ন্যারেটিভও আছে।”

“অনেকেই তাকে বিজেপির বি-টিম হিসেবে দেখেন, কারণ এখনও ভারতীয় মুসলিম সমাজের বেশির ভাগ ভোট কংগ্রেস বা তাদের জোটের দলগুলোই পায় – কিন্তু ওয়াইসি সেই ভোট কেটে বিজেপিরই সুবিধা করে দিচ্ছেন বলে তাদের অভিযোগ,” বলছেন শাহিদ মিও। অনেকে অভিযোগ করছে তিনি ‘বিজেপির দালাল’ হিসাবে কাজ করেছেন।

“এখন নতুন নতুন রাজ্যে তার আবেদন কতটা স্থায়ী হয় সেটা দেখার বিষয় – কিন্তু এখানে অন্তত নানা সেবামূলক কাজকর্ম, ত্রাণ ইত্যাদির সুবাদে বলা যেতে পারে হায়দ্রাবাদ মানেই ওয়াইসি, ওয়াইসি মানেই হায়দ্রাবাদ।”

বিহারে যেমন এই প্রথমবারের মতো ভোটে লড়ল ওয়াইসির দল – আর মুসলিম-অধ্যুষিত সীমাঞ্চল ও আশেপাশে কুড়িটি আসনে প্রার্থী দিয়ে পাঁচটিই জিতে নিয়েছে তারা।

সেইসঙ্গে তারা আরজেডি-কংগ্রেসের জোট ”মহাগঠবন্ধন”কে হারিয়ে দিয়েছে আরও বহু আসনে।

বিহারের পূর্ণিয়া-কাটিহার অঞ্চলে মুসলিম তরুণ-তরুণীরাও বিবিসিকে বলছিলেন, ওয়াইসির মতো বলিষ্ঠ একজন নেতা, যার কোনও অপরাধের ইতিহাসও নেই – তাদেরকে আকৃষ্ট করেছেন।

তবে বিভিন্ন বিষয়ে তার বিতর্কিত বয়ান নিয়েও অনেক মুসলিম আবার সন্দিগ্ধ।

ওদিকে বিজেপির দালাল বা বি-টিম, নিরন্তর এই অভিযোগ শুনতে শুনতে ক্লান্ত আসাদউদ্দিন ওয়াইসিও এখন কড়া ভাষায় এর জবাব দিচ্ছেন।

বিহারের সাফল্যের পর তিনি বলছিলেন, “আমার ইতিহাস মানুষ জানে না। বারো-তেরো বছর বয়স থেকে শুনছি আমাদের বাড়ির সামনে এসে আরএসএস গুন্ডারা নোংরা স্লোগান দিচ্ছে, ওয়াইসি কবরে যাও কিংবা পাকিস্তানে।”

“ভেতর থেকে এটা আমায় আরো শক্ত করে তুলেছে, প্রতিবাদ করে জেলে গিয়ে পুলিশের মারও খেয়েছি,” বলেন ওয়াইসি।

“কোনো শিসমহল থেকে আমি রাজনীতিতে আসিনি, কেউ আমার জন্য মখমলের কার্পেটও বিছিয়ে রাখেনি।

“ফলে কে কী বলল আমার কিচ্ছু যায় আসে না, আর ভোট-কাটুয়া বা বি-টিম পুরনো হয়ে গেছে – অক্সফোর্ড অভিধান ঘেঁটে বরং নতুন গালাগালি খুঁজতে বলব,” পাল্টা কটাক্ষ তার।

ওয়াইসি-র পরবর্তী নিশানা পশ্চিমবঙ্গে মাসছয়েক পরের বিধানসভা নির্বাচন – কিন্তু রাজ্যের প্রধানত বাংলাভাষী মুসলিমদের মধ্যে তার আবেদন কতটা হবে তা নিয়ে সন্দিহান কলকাতার সমাজ বিশ্লেষক শাওনি শবনম।

ড: শবনম বিবিসিকে বলছিলেন, “আসাদউদ্দিন ওয়াইসি খুবই বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব, কারণ নানা বিষয়েই তিনি খুব রক্ষণশীল মনোভাব নিয়ে চলেন। তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কী, তিনি ঠিক কী করতে চান তা নিয়েও বিতর্ক আছে।

“হায়দ্রাবাদের রাজনীতিবিদ উনি, দেশের পশ্চিমাঞ্চলেও কিছুটা প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছেন – কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কতটা সুবিধা করতে পারবেন তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।”

“কলকাতায় কিছু সংখ্যক উর্দুভাষী মুসলিমের মধ্যে হয়তো পারবেন, কিন্তু এ রাজ্যের বেশির ভাগ বাংলাভাষী মুসলিম জনগোষ্ঠী তাকে কতটা গ্রহণ করবেন তা নিয়ে আমি খুব নিশ্চিত নই”, বলছিলেন ড: শবনম।

তবে পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম ভোটে ভাগ বসিয়ে ওয়াইসি তার ক্ষমতায় ফেরার রাস্তা কঠিন করে তুলবেন কি না, সে বিষয়টা তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা ব্যানার্জিকে অবশ্যই দুশ্চিন্তায় রেখেছে।

সূত্র : বিবিসি

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com