দেশে ক্রমবর্ধমান ধর্ষণের ঘটনা ঘটার পেছনে দায়ী `অসুস্থ রাজনীতি’

0

দেশে ক্রমবর্ধমান ধর্ষণের ঘটনা ঘটার পেছনে `অসুস্থ রাজনীতি’ ও ধর্ষকের `রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাকে’ দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রয়োজনীয় `সংশোধনীর’ মধ্য দিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন তারা।

অপরাধ করেও শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়ার বিদ্যমান সংস্কৃতি ভেঙে ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি ও যে কোনো ধরনের যৌন সহিংসতা থেকে নারীদের রক্ষায় পুলিশ, র‌্যাব, প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও নাগরিক সমাজের সদস্যদের সমন্বয়ে একটি উচ্চ-পর্যায়ের জাতীয় কমিটি গঠনের কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমেরিটাস সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান সরকারকে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে জিরো-টলারেন্স নীতি গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন।

দৃশ্যমান শাস্তি দিতে হবে

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, নারীর বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান ধর্ষণ ও সহিংসতা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এগুলোর সাথে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং শাস্তি থেকে মুক্তির পাওয়ার সংস্কৃতির গভীর যোগসূত্র আছে।

তিনি বলেন, ‘ধর্ষণের ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্নভাবে ঘটলেও এগুলো সমাজ ও রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের প্রতিচ্ছবি। দুর্নীতি ও ধর্ষণও একই মূদ্রার উল্টো পিঠ।’

বিশিষ্ট এ শিক্ষাবিদ বলেন, ‘ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও বিভিন্ন অপরাধে জড়িত অপরাধীদের কোনো জবাবদিহিতা নেই এবং তাদের রাজনৈতিক প্রভাব ও আইনের দুর্বল প্রয়োগের ফলে তাদের খুব কমই শাস্তি পান। ধর্ষকরা মনে করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও তাদের শাস্তি হবে না। তারা তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের মাধ্যমে পুলিশকে সামলাতে পারবে। আর এ কারণেই আমরা এখন দেখছি ছাত্রলীগ কর্মীদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগেউঠছে।’

প্রবীণ এ অধ্যাপক বলেন, ‘ধর্ষণ রোধে দোষীদের অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে ও সেই শাস্তি অবশ্যই দৃশ্যমান হতে হবে। রাষ্ট্রকে অবশ্যই অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে এবং দ্রুত বিচার করতে হবে।’

সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মানুষকে বিচ্ছিন্ন, দুর্বল ও শক্তিহীন করে ফেলেছে। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টায় অবৈধভাব অর্থ উপার্জন করে তারা এখন সমাজে শক্তিশালী এবং কোনো ধরনের জবাবদিহিতা ছাড়া যে কোনো কিছু করতে পারেন।

তিনি বলেন, ‘ধর্ষকদের কেবল শাস্তি দিয়েই থামানো যাবে না তাই সামাজ পরিবর্তনের আন্দোলন জরুরি।’

সিরাজুল ইসলাম বলেন, মানুষ এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুবই সক্রিয় এবং সেখানে তারা তাদের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। তবে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতিবাদের প্রভাব এক নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ কেবল নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেই স্বস্তি পাচ্ছে। তবে জনগণের শক্তি দেখানোর মাধ্যমে অপরাধীদের ভয় ধরিয়ে দিতে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে রাস্তায় নেমে আসা উচিত।

তিনি বলেন, নিপীড়ন ও সামাজিক অপরাধ থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রধান উপায় হলো জনগণের শক্তি পুনরুদ্ধার এবং সামাজিক ব্যবস্থাগুলো শক্তিশালী করা।

নৈতিক ও যৌনশিক্ষার ওপর জোর দেয়া

অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, বিভিন্ন কারণে এবং ‘রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তার’ জন্য যে যৌন নির্যাতন মারাত্মক সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘ক্রমবর্ধমান ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতা ঘটার পেছনের প্রধান কারণগুলো হলো পুরুষদের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, পরিব্যাপ্তি প্রবণতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়, পারিবারিক বন্ধনে দুর্বলতা, সমাজে অশান্তি, রাজনীতির অপরাধ, রাজনৈতিক সমর্থন, দুর্বল আইন ও আইনি ব্যবস্থা এবং আইন প্রয়োগের দূর্বলতা।’

সাদেকা বলেন, ‘বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ফলাফলমুখী হয়ে পড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের শিক্ষার্থীদের নৈতিক মূল্যবোধ সম্পর্কে শিক্ষা দিতে স্পষ্টতই ব্যর্থ হচ্ছে। সব অভিভাবক এখন তাদের সন্তানের ভালো ফলাফল এবং ভাল চাকরি নিয়ে ভাবেন। তারা তাদের সন্তানদের ভাল মানুষ হিসেবে তৈরি করার কথা ভাবেন না।’

ঢাবির এ শিক্ষক বলেন, যৌনতার বিষয়ে আমাদের দেশের শিশুরা শিক্ষিত নয়। যৌনশিক্ষা লজ্জাজনক ও ট্যাবু হয়ে রয়েছে। ছেলে ও মেয়ের মধ্যে যে সব জৈবিক পার্থক্য রয়েছে তা আমাদের ছেলেমেয়েদের শিখানো উচিত এবং কীভাবে একে অপরকে শ্রদ্ধা করবে সে সম্পর্কেও শিক্ষা দেয়া দরকার।

সাদেকা বলেন, সবচেয়ে বড় শঙ্কার বিষয় হলো সাম্প্রতিক ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির বেশিরভাগ ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের ‘ক্যাডাররা’ জড়িত।

তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতারা তাদের নিজেদের স্বার্থে যুবকদের অপরাধী ও বিপথগামী করছেন। তারা এমনই পিশাচ হয়ে যান যে ধর্ষণসহ যে কোনো অপরাধে লিপ্ত হওয়ার আগে ভাবেন না। তাই, তাদের সংশোধন করার জন্য পদক্ষেপ নেয়া উচিত।’

ছড়িয়ে পড়া গ্যাং

তারেক শামসুর রেহমান বলেন, যদিও যৌন হয়রানি ও ধর্ষণ সমাজে নতুন কিছু নয়, তবে রাজনৈতিক যোগসূত্রের কারণে এখন অপরাধীদের মধ্যে গুরুতর পরিবর্তন এসেছে।

তিনি বলেন, ‘ধর্ষকদের রক্ষা ও মানবতা বিরুদ্ধে এ ধরনের অপরাধকে কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থন করা উচিত নয়। তবে, এ জাতীয় অপরাধ করার পর অপরাধীরা তাদের রাজনৈতিক বা দলীয় পরিচয় ব্যবহার করতে শুরু করেছেন।’

তারেক বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো ধর্ষকদের এবং অপরাধীদেরকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে উল্লেখ করে তারা তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে চলেন। যদিও তারা এ ধরণের লোকদের তাদের দলের সাথে যেনো না জড়াতে পারে সে ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয় না।’

তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সেসব নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া উচিত যারা জনগণের ওপর নির্যাতন চালাতে ও অপকর্ম করতে অপরাধীদের সমর্থন দেয়।

তারেক বলেন, ‘বেগমগঞ্জে এক মহিলাকে লাঞ্ছিত করা দেলোয়ারের নেতৃত্বে এক কুখ্যাত গ্যাং বহুদিন ধরেই ওই অঞ্চলে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত হয়ে তাদের পেশীশক্তির দেখিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে আসছে। দেশের অনেক এলাকায় এ ধরনের গ্যাং আছে।’

তিনি বলেন, ‘ধর্ষণের মতো সামাজিক অপরাধ বন্ধ করতে হলে আমাদের অবশ্যই অপরাধী এবং তাদের সমর্থনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ এসব অপরাধে সমর্থন দিয়ে থাকে প্রমাণ পাওয়া যায় তবে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে।’

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com