আজারবাইজানের মুসলিম ঐতিহ্য

0

আজারবাইজান এশিয়া মহাদেশের একটি রাষ্ট্র। সরকারি নাম দ্য রিপাবলিক অব আজারবাইজান। কৃষ্ণ সাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী স্থলযোটক দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলের সর্ব পূর্বে অবস্থিত রাষ্ট্র। আয়তন ও জনসংখ্যার দিক থেকে এটি ককেশীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বৃহত্তম। দেশটির উত্তরে রাশিয়া, পূর্বে কাস্পিয়ান সাগর, দক্ষিণে ইরান, পশ্চিমে আর্মেনিয়া, উত্তর-পশ্চিমে জর্জিয়া।

ছিটমহল নাখশিভানের মাধ্যমে তুরস্কের সঙ্গে আজারবাইজানের একচিলতে সীমান্ত রয়েছে। আর্মেনিয়ার পর্বতের একটি সরু সারি নাখশিভান ও আজারবাইজানকে পৃথক করেছে। আজারবাইজানের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে আর্মেনীয় অধ্যুষিত এলাকা নগোর্নো-কারাবাখ নিয়ে দুদেশের বিতর্ক বহু দিনের। সেটা কেন্দ্র করেই কয়েক দিন ধরে যুদ্ধ চলমান।

কাস্পিয়ান সাগরে অবস্থিত অনেকগুলো দ্বীপও আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত। আজারবাইজানের রাষ্ট্রভাষা আজারবাইজানি। কাস্পিয়ান সাগরতীরে অবস্থিত বন্দর শহর বাকু আজারবাইজানের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। ‘ইউরোশিয়া’ অঞ্চলের এশীয় দেশ আজারবাইজানের আয়তন ৮৬ হাজার ৬৬০ বর্গকিলোমিটার।

বিভিন্ন সাম্রাজ্যে

১৮০০ ও ১৯০০ শতকে ককেশীয় এই দেশ পর্যায়ক্রমে রুশ ও পারস্য দেশের শাসনাধীন ছিল। রুশ গৃহযুদ্ধকালীন সময়ে ১৯১৮ সালের ২৮ মে তৎকালীন আজারবাইজানের উত্তর অংশটি একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কিন্তু মাত্র দুই বছরের মাথায় ১৯২০ সালে বলশেভিক লাল সেনারা এটি আক্রমণ করে আবার রুশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে এবং ১৯২২ সালে দেশটি আন্তঃককেশীয় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অংশ হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়।

১৯৩৬ সালে আন্তঃককেশীয় সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রটি ভেঙে তিনটি আলাদা প্রজাতন্ত্রÑ আজারবাইজান, জর্জিয়া ও আর্মেনিয়ায় রূপান্তর করা হয়। তখন থেকেই আজারবাইজান ও আর্মেনীয়দের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। ১৯৯১ সালের ১৮ অক্টোবর আজারবাইজান স্বাধীনতা লাভ করলে এই দ্বন্দ্ব সশস্ত্র সংঘাতে রূপ নেয়। ফলে নতুনভাবে স্বাধীন দেশটির প্রথম বছরগুলো রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক অবনতি এবং নগোর্নো-কারাবাখের যুদ্ধে অতিবাহিত হয়।

বিতর্কিত নগোর্নো-কারাবাখ

নগোর্নো-কারাবাখ নিয়ে চার দশক ধরে এই দুদেশ দ্বন্দ্বে লিপ্ত। নগোর্নো-কারাবাখ আজারবাইজানের বলেই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। কিন্তু এটি নিয়ন্ত্রণ করে জাতিগত আর্মেনিয়ানরা। গত জুলাই মাসেও দুদেশের মধ্যে লড়াইয়ে ১৬ জন নিহত হন। এ ঘটনার পর আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে বিরাট বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। এই বিক্ষোভ থেকে নগোর্নো-কারাবাখ অঞ্চল পুনর্দখলে পূর্ণ সামরিক শক্তি প্রয়োগের আহ্বান জানানো হয় সরকারের প্রতি।

পাহাড়-পর্বত, নদী, সাগর ও সবুজ ভূমিতে সমৃদ্ধ দেশ আজারবাইজান। রয়েছে তেল, গ্যাস ও লোহার মতো মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। তবে তেল ও তেলশিল্পের ওপরই টিকে আছে দেশটির অর্থনীতি। রাজধানী বাকুর তেলক্ষেত্রগুলো বিশ্বের অন্যতম সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তেলক্ষেত্র হিসেবে গণ্য। কিন্তু দুর্নীতি, সংঘবদ্ধ অপরাধ ও দুর্বল সরকারের কারণে দেশটি খনিজসম্পদ থেকে সম্ভাব্য মুনাফা অর্জনে ব্যর্থ।

ইসলামের আগমন

আজারবাইজানের ১০ কোটি জনসংখ্যার ৯৬.৯ শতাংশই মুসলিম। হিজরি প্রথম শতকেই আজারবাইজানে ইসলামের আগমন ঘটে। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর সময়ে আজারবাইজানে ইসলামের জয়যাত্রা শুরু হয়। আজারবাইজানে প্রথম অভিযান পরিচালিত হয় উতবা ইবনে ফারকাদ (রা.)-এর নেতৃত্বে। তার অভিযানের মুখে সাসানি সাম্রাজ্যের নিযুক্ত প্রশাসক ‘মিরজিয়ান’ সন্ধি করতে বাধ্য হন। তারপর হুজাইফা ইবনে ইয়ামান (রা.) ‘আরবিল’ জয় করেন। এরপর একে একে অভিযান পরিচালনা করেন মুগিরা ইবনে শুবা, আশআস ইবনে কায়েস ও সারাকা ইবনে আমর (রা.)। তাদের অভিযানে আজারবাইজানের বেশির ভাগ ভূমি ইসলামি খেলাফতের অধীনে চলে আসে। এ সময় ফারকাদ আস সুলামিকে এই অঞ্চলের গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে ইসলামের বিস্তৃতি ঘটে এ অঞ্চলে। এ সময় মিসর ও সিরিয়ার মুসলিম আরবরা এ অঞ্চলে বসতি স্থাপন শুরু করে। ক্রমান্বয়ে ইসলাম আজারবাইজানের জনগণের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। মাত্র এক শতকের ব্যবধানে ইসলাম সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মে পরিণত হয়।

ইসলামের প্রাথমিক যুগে উমাইয়া খলিফা হিশাম ইবনে আবদুল মালিকের যুগে আজারবাইজানে ইসলামের অগ্রগতি সবচেয়ে বেশি হয়। তিনি এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের পাশাপাশি ইসলামি খেলাফতের সীমানা বিস্তারেও মনোযোগ দেন। তার সময়ে ‘ওরসান’ ও ‘বুরঝান্দ’ নামে দুটি ইসলামি নগরের গোড়াপত্তন হয় এবং জাররাহ ইবনে আবদুল্লাহর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী দক্ষিণ আজারবাইজানের ‘আল খুরঝ’ জয় করে। আব্বাসীয় আমলেও এই অঞ্চলের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকে। এ সময় মুসলিমরা আজারবাইজানের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

হিজরি পঞ্চম শতকে আজারবাইজান সেলজুকদের শাসনাধীন হয়। সেলজুক শাসনামলে এই অঞ্চলে সুফিবাদের বিস্তৃতি ঘটে। তাদের শাসনামলেই আজারবাইজানে শিয়া মতবাদের বিস্তৃতি ঘটে। সেলজুকদের পর আজারবাইজান উসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

সোভিয়েত আমলে

আঠারো শতকের শেষভাগে প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্রের শাসকদের দুর্বলতা প্রকাশ পেতে থাকলে রাশিয়া তাদের ওপর চড়াও হয়। সীমান্তবর্তী মুসলিম দেশগুলোর ওপর তার হামলা ও আগ্রাসন বৃদ্ধি পায়। ১৮০১ ও ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে দুই দফা তৎকালীন মুসলিম পারস্যের ওপর হামলা করে রাশিয়া ও জর্জিয়া, আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার বিস্তৃত ভূমি দখল করে নেয়। অবশ্য মুসলিম শাসকরা এই অঞ্চল থেকে হাত গুটিয়ে নিলেও স্থানীয় মুসলিম নেতাদের কেউ কেউ প্রতিরোধের চেষ্টা করেন, যা দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীকাল পর্যন্ত টিকে ছিল। ১৮৫৯ সালে ইমাম শামিলের পরাজয় বরণের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে রুশ আগ্রাসন রোধের শেষ সম্ভাবনাটুকু শেষ হয়ে যায়। আজারবাইজানের পূর্ণ ভূমি রাশিয়া পুরোপুরি দখল না করলেও এই অঞ্চলের মুসলিম শাসকদের মধ্যে বিরোধ উসকে দিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা হতো। অবশেষে ১৯০৮ সালে ব্রিটিশ বাহিনীর সমর্থনে রাশিয়া আজারবাইজানে প্রবেশ করে। ২১ অক্টোবর ১৯২০ জনগণের মতামত উপেক্ষা করে আজারবাইজানকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

সোভিয়েত-পরবর্তী আজারবাইজান

সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্তির পর রুশ সরকার আজারবাইজান থেকে ইসলাম ও ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি মিটিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সব ধরনের ধর্মচর্চার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। আরব-সংস্কৃতির পরিবর্তে রুশ সংস্কৃতির প্রচার-প্রসারে লিপ্ত হয়। আগে আরবি বর্ণে আজারবাইজানি লেখা হলেও তার পরিবর্তে রুশ বর্ণে লেখার ফরমান জারি করা হয়। অসংখ্য মসজিদ-মাদ্রাসা বন্ধ করে দেওয়া হয়। রুশ শাসনামলে আজারবাইজানে মসজিদের সংখ্যা দুই হাজার থেকে মাত্র ১৬-তে নেমে আসে। তবে স্বাধীনতার পর তা আবার বাড়তে থাকে। বর্তমানে আজারবাইজানে ১ হাজার ৮০০ মসজিদ রয়েছে। রুশ শাসনামলে বিপুলসংখ্যক রুশ নাগরিক আজারবাইজানে বসতি স্থাপন করে। যাদের সংখ্যা একসময় ১০ শতাংশে উন্নীত হয়। ১৮ অক্টোবর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে আজারবাইজান।

আজারবাইজানের তরুণ প্রজন্ম ইসলামপরায়ণ। তারা ক্রমেই ইসলামের প্রতি ঝুঁকছে। বাকু রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (বিআরআই) এক প্রতিবেদনে ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আজারবাইজানের মুসলমানের ধর্মীয় প্রবণতা তুলে ধরা হয়েছে। যাতে দেখানো হয়েছে, এই তিন বছরে ধর্মবিমুখতার হার ৫৯ থেকে ৪১ শতাংশে নেমে এসেছে। অন্যদিকে ধার্মিকদের সংখ্যা ১৬ থেকে ২৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

একই সঙ্গে সে দেশে মসজিদ ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে। সরকারও ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি নমনীয় হচ্ছে। ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা লাভের সময় আজারবাইজানে মাত্র একটি মাদ্রাসা (ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান) ছিল। ২০০০ সালে যার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩০-এ। যার মধ্যে সরকার অনুমোদিত ৩০টি মাদ্রাসাও রয়েছে। বাকুতে অবস্থিত মাদ্রাসাটিকে ১৯৯২ সালে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা হয়। সম্প্রতি সরকার সাতটি ইসলামিক কলেজের অনুমোদন দিয়েছে এবং ঘোষণা করেছে চলতি বছর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com