স্ট্যাটাস ও বক্তব্যে কাউকে বিদ্রুপ-ব্যঙ্গ করা যাবে কি?

0

লেখালেখি কিংবা আলোচনায় সংযত হওয়া খুবই জরুরি।  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাণ্ডিত্য দেখাতে কিংবা আত্ম-অহমিকায় অনেকে নানান ধরণের লেখা ও বক্তব্য দিয়ে থাকেন। এসব লেখা-লেখি বা বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় অনেকেই আবার আক্রমণাত্মকভাবে বিদ্রুপ বা ব্যঙ্গ করে থাকেন। আক্রমণাত্মকভাবে ব্যঙ্গ বা বিদ্রুপ করে কোনো বক্তব্য দেয়া কি ইসলাম সমর্থন করে?

বিশ্ববিখ্যাত ইসলামিক স্কলার আল্লামা তকি ওসমানি কর্তৃক নির্ধারিত বিষয়ের ওপর এমনই একটি বই লেখার ঘটনা লেখক-আলোচক ও স্ট্যাটাস দেয়া ব্যক্তিদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও শিক্ষণীয়। এ লেখাটি ‘তালিবানে ইলম : পথ ও পাথেয়’ গ্রন্থে সে ঘটনাটি তুলে ধরা হয়েছে। তাহলো-

সামরিক শাসক আইয়্যুব খান তার শাসনামলে মুসলিম আইনকে পাশ কাটিয়ে একটি পারিবারিক আইন জারি করেছিল। সে সময় স্থানীয় অধিকাংশ আলিম এ আইনের বিরোধিতা করেছিলেন।

এরই মাঝে এক ব্যক্তি আইয়্যুব খানের জারি করা পারিবারিক আইনের পক্ষে সাফাই গেয়ে একটি বই লেখেন। যাতে কুরআন-সুন্নাহর অপব্যাখ্যা করে দলিল-প্রমাণ তুলে ধরা হয। ওই বইতে লেখক আইয়্যুব খানের জারি করা পারিবারিক আইনকে কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী নয় বলেও উল্লেখ করেন।

সে সময় আল্লামা তকি ওসমানি টগবগে যুবক। তাঁর বাবা বিচারপতি শাফি ওসমানি আইয়্যুব খানের জারি করা পারিবারিক আইনের পক্ষে সাফাই গাওয়া ওই বইয়ের একটি সঠিক জবাব লেখার জন্য তকি ওসমানিকে নির্দেশ দেন। যাতে মানুষ মানুষ এ আইনে বিভ্রান্ত না হয়।

তকি ওসমানি বাবার নির্দেশক্রমে যৌবনের টগবগে উৎসাহ উদ্দীপনায় ওই বই ও বইয়ের লেখককে তীব্রতর আক্রমণাত্মক ভাষায় ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে সমালোচনায় পরিপূর্ণ আরেকটি বই লেখেন। লেখককে অনেক উপহাসও করা হয় এই বইটিতে।

বইটি প্রকাশের আগে তিনি তাঁর বাবাকে তা দেখতে দেন। তাঁর বাবা বইটি পড়ে তাঁকে বলেন-

‘বাবা! তুমি তো সাহিত্যের বিচারে খুব সুন্দর কিতাব লিখেছ। এর সাহিত্যমান অনেক উন্নত। কিন্তু আমাকে বল, তুমি এটা কী জন্য লেখেছ?

কিন্তু কিতাব লেখার উদ্দেশ্য যদি হয় এমন! যে-

– যারা আগে থেকে তোমার পক্ষে আছে তারা তোমাকে বাহবা দেবে এবং বলবে, বাহ! কত চমৎকার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছে! কী শক্তিশালী কায়দায় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা হয়েছে। ভক্তদের এমন প্রশংসা লাভের জন্য লিখে থাকলে এটি খুবই সফল একটি কিতাব। তোমার পক্ষের লোকেরা এই কিতাব পড়লে পঞ্চমুখে তোমার প্রশংসা করবে।

– আর যদি উদ্দেশ্য হয় যে, যারা পারিবারিক আইনের পক্ষে লেখা কিতাব পড়ে গোমরাহ হয়েছে, তাদেরকে পুনরায় পারিবারিক আইনের ব্যাপারে সঠিক চিন্তা-ভাবনা করতে উৎসাহিত করা এবং তাদের সঠিক পথে আনার চেষ্টা করা। তবে তোমার লেখা এই কিতাবের কানাকড়ি মূল্যও নেই।

কারণ, তুমি তোমার কিতাবে শক্ত ভাষায় আক্রমণাত্মকভাবে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করার মাধ্যমে প্রথমেই তাদের (জারি করা পারিবারিক আইনের পক্ষের লোকদের)  বীতশ্রদ্ধ করে দিয়েছ।

সঠিক কথা বোঝাতে তোমার লেখা কিতাব পড়ে প্রথমেই তারা এটা ভাববে যে-

এ কিতাব তো আমাদের বিপক্ষের কেউ লিখেছে। আমাদের সঙ্গে দুশমনি করে লিখেছে। ফলে তারা তোমার লেখা কিতাব থেকে কিছু গ্রহণ করতে পারবে না।

সুতরাং এই কিতাব লেখার উদ্দেশ্য যদি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা এবং মানুষের হেদায়াতের পথ সুগম করা না হয়ে থাকে তাহলে তোমার এই কিতাবের এক পয়সাও দাম নেই।’

তকি ওসমানির প্রতি তার বাবার নসিহত-

‘দেখ! আল্লাহ যখন হজরত মুসা আলাইহিস সালাম ও হজরত হারূন আলাইহিস সালামকে ফেরাউনের কাছে পাঠালেন, তখন তাদের উভয়কে ফেরাউনের সঙ্গে নরম ভাষায় কথা বলতে বলেছিলেন-

اذْهَبَا إِلَى فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَى – فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَّيِّنًا لَّعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى

‘তোমরা উভয়ে ফেরাউনের কাছে যাওসে খুব উদ্ধত হয়ে গেছে। অতপর তোমরা তার সঙ্গে নম্র ভাষায় কথা বলহয়তো সে চিন্তা-ভাবনা করবে অথবা ভীত হবে।’ (সুরা ত্বহা : আয়াত ৪৩-৪৪)

অথচ আল্লাহ তাআলা আগে থেকেই জানতেন যে, ফেরাউন তাদের উভয়ের নসিহত গ্রহণ করবে না। তারপরও তিনি ফেরাউনের সঙ্গে নম্র ভাষায় কথা বলার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

তকি ওসমানির ভাষায়আব্বাজান বললেন-

‘তুমি হজরত মুসা আলাইহিস সালামের চেয়ে বড় মুসলিম (আন্তরিক) দাঈ হতে পার না আর তোমার প্রতিপক্ষও (বিভ্রান্তিমূলক পারিবারিক আইনের পক্ষে লেখা বইয়ের লেখক) ফেরাউনের চেয়ে বেশি গোমরাহ নয়।

ফেরাউনের সঙ্গেই যখন নরম ভাষায় কথা বলার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে তাহলে আমি আর তুমি কোন কাতারে শামিল হব?

সুতরাং (বই লেখা) যদি কারও হেদায়েতই উদ্দেশ্য হয়, তাহলে দাওয়াতের ওই পয়গাম্বরী পন্থা অবলম্বন করা ছাড়া আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন না।’

তাকি ওসমানি বলেন

‘[এরপর] পুরো কিতাব পুনরায় লিখেছি এবং তাতে আক্রমণাত্মক ও ব্যঙ্গাত্মক যেসব কথাবার্তা ছিল তা সম্পূর্ণ বাদ দিয়েছি।’

তকি ওসমানির বাবা তাঁকে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন-

‘…একটি সময় তো অবশ্যই আসবে যখন আহকামুল হাকিমিনের (আল্লাহর) আদালত কায়েম হবে এবং সেখানে অবশ্যই তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে। যে কথাই তোমার জবান থেকে বের হচ্ছে তা সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কাছে রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে। তাই যে কথাই বল চিন্তা করে বল।’

সুতরাং বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী, স্ট্যাটাস দেয়া ব্যক্তি কিংবা সরব সব লেখক, আলোচক ও বক্তাদের জন্য আল্লামা তকি ওসমানির এ ঘটনায় রয়েছে চমৎকার ও যুগোপযোগী শিক্ষা।

সমালোচনা কিংবা গঠনমূলক আলোচনাসহ যে কোনো স্ট্যাটাস, বক্তব্য যেন আক্রমণাত্মক কিংবা ব্যঙ্গাত্বক না হয়; সে দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখা জরুরি। কেননা মানুষের প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে অবশ্যই আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সব সেক্টরে মন্তব্য, স্ট্যাটাস কিংবা আলোচনায় আক্রমণাত্মকভাবে বিদ্রুপ ও ব্যঙ্গাত্বক বিষয়গুলো থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। উত্তম কথা ও লেখনির মাধ্যমে সংযত হয়ে নিজ নিজ বক্তব্য তুলে ধরার তাওফিক দান করুন। আমিন।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com