ক্ষমতা ও বিচারহীনতায় অপ্রতিরোধ্য ধর্ষকরা

0

দেশে ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে নানা ধরনের নিষ্ঠুরতা। ক্ষমতা ও বিচারহীনতার কারণে এ ধরনের অপরাধীরা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল্যবোধ ও নৈতিক অবক্ষয়ের কারণেও সমাজে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। ধর্ষণ রুখতে হলে এ মুহূর্তে বড় ধরনের একটা সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন দরকার বলে মনে করছেন তারা। বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক কমিটমেন্ট ছাড়া এ ধরনের ঘৃণ্য ঘটনা কমবে না। কারণ দিনশেষে তারাই দেশ চালাবেন, তারাই সমাজকে এগিয়ে নিবেন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩ হাজার ১শ’র বেশি নারী ও শিশু। এ সময়ে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ১৮০ জনকে।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও আইনি ব্যবস্থা ধর্ষককে সুরক্ষা দেয়ার সংস্কৃতি লালন করে চলেছে। আইনে আছে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে, বিশেষ ক্ষেত্রে কারণ দেখিয়ে কিছুটা সময় নিতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, মামলা শেষ হতে ১০ বছর, ২০ বছরও লেগে যাচ্ছে। বর্তমানে ধর্ষণের ক্ষেত্রে ক্ষমতার বিষয়টি বেশি সম্পর্কিত। ক্ষমতার দম্ভের কারণে সমাজে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। ধর্ষকের হাত থেকে তিন বছরের শিশুও রেহাই পাচ্ছে না। পরিচিতজনদের মাধ্যমে ধর্ষণের ঘটনাও বাড়ছে। সবকিছুর মূলে আছে মূল্যবোধের অভাব। এছাড়া অবাধ পর্নোগ্রাফির বিস্তার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্বল্পপরিচয়ের পর কোনো ছেলের সঙ্গে বাছবিচার না করেই মেলামেশা ইত্যাদি। তিনি বলেন, বিভিন্ন চ্যানেল, বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশের কিছু চ্যানেলে যা দেখানো হয়, তা-ও ধর্ষণের মতো অপরাধকে উসকে দিচ্ছে। ছেলেমেয়েরা ইন্টারনেটে কোন সাইট দেখছে, তা-ও অভিভাবকরা কখনও নজরে আনছেন না। এই সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করে নতুন সংস্কৃতি নির্মাণ সম্ভব না হলে ধর্ষণ কমানো যাবে না। তিনি বলেন, ধর্ষণ কেউ সাক্ষী রেখে করে না, ফলে সামাজিক নিন্দার বাধা অতিক্রম করে কেউ ধর্ষণের বিচার চাইলেই বর্তমান বিচার কাঠামোতে ন্যায্য বিচার পাওয়া সম্ভব না-ও হতে পারে। তাই প্রয়োজন সামাজিক প্রতিরোধ।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মহাসচিব নূর খান লিটন বলেন, বিচারহীনতা এবং ভয়ের সংস্কৃতির কারণেই ধর্ষকরা অনেকটা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। ক্ষমতা আর বিত্তের কাছে বিচারপ্রার্থীরা অসহায়। এর কারণ, দুর্বৃত্তরা দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ের ওপর ভর করেছে। তাদের ধারণা যে কোনো অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি একটি বড় ধরনের কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, সিলেটে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দ্বারা যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, সেদিন রাতে চেষ্টা হচ্ছিল এর সমঝোতা প্রক্রিয়ার। যদি সেই খবর সত্যি হয়, তবে শুধু ধর্ষকদের শাস্তি দিলেই হবে না, তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদেরও বিচার করা উচিত। এখানে নৈতিকার যে স্খলন ঘটেছে, সেটাকে চিহ্নিত করা উচিত। তাদের নিজেরাই আত্মসমালোচিত হওয়া উচিত। সমাজ ও রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে রাজনীতিবিদদের উদ্যোগী হতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, দেশের যে সামাজিক বলয় তাতে বিচারহীনতা ও নিরাপত্তাহীনতার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। শিক্ষাঙ্গনে ধর্ষণের ঘটনা আমাদের জন্য লজ্জার। সামনের দিনগুলোয় নারীর ওপর নির্যাতনের বিচার না হলে ভবিষ্যতে এর মাত্রা আরও বাড়বে, যা হবে সত্যিই দুঃখজনক। তিনি বলেন, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। সবাইকে সচেতন হতে হবে। সমাজের সবাইকে এক হয়ে এ ধরনের হীন কাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। সমাজের সবাই সচেতন হলেই এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। পাশাপাশি দোষীরা যাতে শাস্তি পায়, সেই দিকটাও নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, যত দ্রুত সম্ভব বিচারকার্য সম্পন্ন করতে হবে। কারণ এসব ঘটনা ৬ মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলে এর শাস্তি সমাজে তেমন কোনো বার্তা দেয় না।

শুক্রবার সন্ধ্যায় স্বামীর সঙ্গে সিলেট এমসি কলেজে ঘুরতে গিয়ে এক নববধূ ছাত্রলীগের কতিপয় নেতাকর্মীর দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হন। জোরপূর্বক কলেজের ছাত্রাবাসে নিয়ে স্বামীকে আটকে রেখে ওই তরুণীকে গণধর্ষণ করে তারা। পরে রাত ১১টায় শাহপরাণ থানা পুলিশ তাদের উদ্ধার করে। এ ঘটনার পরপরই তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মাঝে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তারা ধর্ষণকারীদর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা শূন্যের কোঠায় আনার দাবি তুলছেন। বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজনিন সুলতানা বলেন, ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। তাতে অন্তত কিছুটা হলেও স্বস্তি আসবে। তিনি বলেন, আমাদের সমাজে কিছু পুরুষ ধর্ষণকে ক্ষমতার প্রদর্শন বলে মনে করে। এ জায়গা থেকে মানসিকতার উত্তরণ ঘটাতে হবে। বেসরকারি একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা ফারহান হোসেন বলেন, অপরাধ দমনে আইনের কঠোর প্রয়োগ ও দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক বিচারের ব্যবস্থা করা হলে ধর্ষণ যে একটি নিকৃষ্ট ঘটনা, তা সমাজে বার্তা দেবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির ইতি টানবে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com