রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে সুদ মওকুফের হিড়িক

0

সরকারি ব্যাংকে সুদ মওকুফের হিড়িক পড়েছে। গত ১২ বছরে সরকারি খাতের ৮ ব্যাংক সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি সুদ মওকুফ করে দিয়েছে। সুদ মওকুফে সবচেয়ে বেশি উদারতা দেখিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের তৃতীয় বৃহত্তম ব্যাংক বলে বিবেচিত অগ্রণী ব্যাংক। মূলধন ঘাটতিতে থাকা এই ব্যাংকটি একাই ১২ বছরে (২০০৯ থেকে চলতি ২০২০ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) সুদ মওকুফ করেছে চার হাজার ২৯১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি- এই দুই মাসে ৮ ব্যাংক এক হাজার ৩০৭ কোটি ৭২ লাখ টাকা সুদ মওকুফ করেছে। ১২ বছরে তিনবার সুদ মওকুফের অঙ্ক দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এই তিনবার হচ্ছে ২০১০, ২০১১ ও ২০১৯ সাল। 

গেল সপ্তাহে জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সুদ মওকুফের এ চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত তথ্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি ২০২০ সালে ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মওকুফকৃত সুদের পরিমাণ ১৪ হাজার ৫৬০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। 
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এই বিপুল পরিমাণ সুদের অর্থ দিয়ে পদ্মা সেতুর অর্ধেক নির্মাণ ব্যয় মেটানো যেত। সাড়ে তিন কোটি গরিব মানুষকে এককালীন দুই হাজার ৫০০ টাকা দেয়া যেত। বর্তমানে ৫০ লাখ গরিবকে আড়াই হাজার টাকা প্রদান করা হচ্ছে। চলমান মেট্রোরেলের বেশির ভাগ কাজ এই অর্থের মাধ্যমে করা যেত। 

সুদ মওকুফের বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড.আহসান এইচ মনসুর গতকাল শনিবার বলেন, সাধারণত দেখা যায়, কোনো ঋণগ্রস্ত কোম্পানি যদি যৌক্তিক কারণে সুদ দিতে অপারগ হয় তখন সেখানে আসল অর্থ পাওয়ার জন্য সুদ মওকুফ করার প্রয়োজন হয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক ভালো কোম্পানির সুদও মওকুফ করে দেয়া হয়েছে। এই প্রসঙ্গে তিনি দেশের নামকরা দু-একটি কোম্পানির নাম উল্লেখ করেন, যাদের সুদ রাজনৈতিক বিবেচনায় মওকুফ করে দেয়া হয়েছে। 

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং আইএমএফের সাবেক এই কর্মকর্তা আরো বলেন, ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের যে সুযোগ সরকার দিয়েছে, তাতে করে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এখানেও সুদ মওকুফ করা হয়েছে; যা করা উচিত হয়নি বলে আমি মনে করি। আর এতে করে সরকারি ব্যাংকের সুদ মওকুফের পরিমাণও সাম্প্রতিককালে বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন সরকার জনগণের করের টাকা দিয়ে এই সব দুর্বল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে মূলধন খাতে অর্থায়ন করবে; যা কখনোই করা উচিত নয়। এখন আমাদের ভাবতে হবে এসব ব্যাংক রাখার কোনো প্রয়োজন আছে কি না। 

এ দিকে অর্থমন্ত্রীর দেয়া বিবৃতি অনুযায়ী ১২ বছরে সবচেয়ে বেশি সুদ মওকুফ করা অগ্রণী ব্যাংকের পর রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণের তকমা যার সেই জনতা ব্যাংক। এই ব্যাংকটি ১২ বছরে সুদই মওকুফ করেছে তিন হাজার ৭৪৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। একই সময়ে সোনালী ব্যাংক সুদ মওকুফ করেছে তিন হাজার ৩৮৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা। রূপালী ব্যাংক সুদ মওকুফ করেছে এক হাজার ৩২৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এক হাজার ৩০৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) ৩২২ কোটি ৬১ লাখ টাকা। বেসিক ব্যাংক ১০১ কোটি ৯৮ লাখ টাকা এবং একই সময়ে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের সুদ মওকুফের পরিমাণ ছিল ৭৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা। 

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদ মওকুফ করা হয়েছে গত বছর (২০১৯) এবং চলতি ২০২০ সালের প্রথম দুই মাস (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি)। ২০১৯ সালে সুদ মওকুফের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৮৩৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা এবং চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসেই সুদ মওকুফ করেছে ৮ ব্যাংক এক হাজার ৩০৭ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এর আগে মাত্র দুইবার সুদ মওকুফ দুই হাজার কোটি টাকার ঘর অতিক্রম করে। একবার ২০১০ সালে, সেবার সুদ মওকুফের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ১০৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা এবং পরের বছর ২০১১ সালে সুদ মওকুফ হয়েছিল দুই হাজার ৩৫৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। 

এই বছরের প্রথম দুই মাসে সবচেয়ে বেশি সুদ মওকুফ করেছে অগ্রণী ব্যাংক যার পরিমাণ ৬২৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এরপর রয়েছে রূপালী ব্যাংক, ২৯০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ২২৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। সোনালী ব্যাংক ১০১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। জনতা ব্যাংক ৬২ কোটি টাকা।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com