কাশ্মীর নিয়ে মোদির জুয়াখেলা এবং পাকিস্তানের নীতি বিকল্প
ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেয়া হয়েছিল। সন্দেহ নেই যে, এ অঞ্চলের নির্যাতিত মুসলিম জনগোষ্ঠির দীর্ঘ সংগ্রামকে শেষ করে দেয়ার জন্যই এই বড় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ধারণা করা হয়েছিল এই পদক্ষেপের ফলে এ অঞ্চলের প্রতিরোধ আন্দোলন তার গতি হারিয়ে ফেলবে। আর এ অঞ্চলের উপর নয়াদিল্লীর একচেটিয়া কর্তৃত্বও প্রতিষ্ঠিত হবে।
ভারত সরকার আশা করেছিল বিতর্কিত অঞ্চলে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসলে সামরিক উপস্থিতি কমিয়ে আনা হবে। এই বিশ্বাসও ছিল যে, উন্নয়নে আরও বরাদ্দ বাড়ালে আর্থসামাজিক পরিস্থিতির উন্নতি হবে, কাশ্মীরে শান্তি আর সমৃদ্ধির নতুন যুগের সূচনা হবে।
এই সব বিবেচনার বাইরেও ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) কাশ্মীরকে সংযুক্তির বিষয়টিকে ঐতিহাসিক অর্জন হিসেবে ভারতের বাকি অংশে মার্কেটিং করতে চেয়েছিল। ক্ষমতাসীন দলের মূল সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘকে (আরএসএস) খুশি করার বিষয়টিও এখানে আছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদী এই সংগঠনের অনুসারীরা প্রায়ই ভারতীয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘন ঘন সহিংসতায় লিপ্ত হচ্ছে।
এক বছর পরে দেখা যাচ্ছে, এই সব হিসাব নিকাশের অধিকাংশই সেভাবে মেলেনি।
কাশ্মীরের মানুষ আর রাজনৈতিক নেতাদের উপর বিধিনিষেধ এখনও প্রত্যাহার হয়নি; সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ রয়েছে; ইন্টারনেট সুবিধা সীমিত; যোগাযোগের মাধ্যমগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে; ভিন্ন মতের অধিকাংশ মানুষদের এখনও আটকে রাখা হয়েছে। সেখানে মিডিয়ার প্রবেশাধিকার খুবই সীমিত, এবং কঠোরভাবে সেন্সরশিপ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে এ অঞ্চলে। কাশ্মীরের অর্থনীতি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে। বাজার বন্ধ থাকায় কৃষিপণ্য পচে যাচ্ছে, আর পরিবহন ব্যবস্থাও পুরোপুরি থমকে আছে।
এই বন্দি অবস্থা কতকাল টিকতে পারে? বাজার, পরিবহন সেবা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কখন খুলবে? কাশ্মীরী রাজনৈতিক বন্দিদের কখন মুক্তি দেয়া হবে?
২০১৯ সালের ৫ আগস্টের পদক্ষেপের ঝুঁকি পুরোটা বিজেপির নেতারা বুঝেছেন বলে মনে হয় না। সমর্থকদের তুষ্ট করতে মুসলিম-বিদ্বেষী মনোভাবটাকে ব্যবহার করছেন তারা। এই পদক্ষেপ দেশের জন্য কি ধরনের অবমাননা আর অপমান নিয়ে আসবে, সেটা ভেবে দেখছেন না তারা। উদীয়মান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে পরিস্থিতির পর্যালোচনা কি করা হতে পারে? বিজেপি-নেতৃত্বাধীন সরকার যতদিন ক্ষমতায়, ততদিন অন্তত সেটা হবে না।
সীমান্তে যখন এই অবস্থা, সেখানে ইসলামাদের সামনে বিকল্পগুলো কি কি?
এই প্রশ্নটা তোলা জরুরি কারণ পাকিস্তানের জবাবও হচ্ছে স্বাভাবিকভাবে প্রতীকী, যার মধ্যে সারবত্তা নেই। পাকিস্তান নতুন একটি রাজনৈতিক মানচিত্র প্রকাশ করেছে, যেখানে কাশ্মীরকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। ব্যাপকভাবে এই মানচিত্রের প্রচারণা চালানো হয়েছে, যেন এটা একটা বড় অর্জন। এই রকম আগ্রাসী ঘোষণা এবং কাঁচা আবেগ প্রদর্শনের ক্ষেত্রে সম্ভবত খুব কম দেশই পাকিস্তানকে হারাতে পারবে।
বরং বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ হবে কাশ্মীরের বাস্তব পরিস্থিতির বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরা এবং এর মাধ্যমে ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করা এবং গত বছরের নেয়া পদক্ষেপ পুনর্বিবেচনায় বাধ্য করা। এই পদক্ষেপ কিছুটা কাজ করলেও নয়াদিল্লীর নীতি বদলাতে সেটা পুরোপুরি সফল হবে না। কারণটা স্পষ্ট। ভারত একটি বড় দেশ এবং কাশ্মীরে তারা বর্বরতা চালালেও এখনও কার্যকর গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে তারা টিকে আছে। বড় বা ছোট কোন দেশই চাইবে না কাশ্মীরের আট মিলিয়ন মানুষের জন্য তারা ভারতের সাথে তাদের সম্পর্ক নষ্ট করবে।
আরেকটি বিনয়ী কৌশল হবে একটা পরিবেশ তৈরি করা। উপত্যকার প্রতিরোধের শক্তির ভিত্তিতে একটা পরিবেশ তৈরি করা, যাতে কংগ্রেস পার্টি নির্বাচনে জিততে পারে। ভারতের মুসলিমদের একজোট হয়ে কংগ্রেসকে সমর্থন করা উচিত। ২০০ মিলিয়ন মুসলিমের সম্মিলিত সমর্থনের ভিত্তিতে কংগ্রেস যদি ক্ষমতায় ফিরে আসে, তাহলে কাশ্মীরের ২০১৯ পূর্ববর্তী মর্যাদা হয়তো ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
জাতিসংঘের ভূমিকা এখানে মূলত অপ্রাসঙ্গিকই থাকবে। ভারতের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোরও জোরালো ও দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে নয়াদিল্লীর সাথে। কাশ্মীরের পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করার জন্য এই সম্পর্ককে তারা ছাড়তে চাইবে না।
সে কারণে ভারতের মধ্যে কাশ্মীর ইস্যুতে সমর্থন গড়ে তোলার কৌশল নিতে হবে। এর মধ্যে থাকবে ব্যাপকভিত্তিক মানবাধিকারের নীতিমালা, ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর বর্বরতা, এবং বিতর্কিত অঞ্চলে কঠিন পরিস্থিতিতে বসবাসরত হাজার হাজার মানুষের জীবনযাত্রার বিষয়ে জনমত তৈরি করা।
কাশ্মীরকে পাকিস্তানের অংশ দেখিয়ে রাজনৈতিক মানচিত্র প্রকাশ করে বাস্তবতার কোন পরিবর্তন করা যাবে না। এতে বরং কাশ্মীরী জনগণের ক্ষতিই হতে পারে কারণ বাকি বিশ্ব পরিস্থিতিটাকে শুধুমাত্র ভূখণ্ডের বিবাদ হিসেবে দেখতে পারে। তখন নিজেদের অবস্থান নিয়ে কিভাবে সমবেদনা তৈরি করবে পাকিস্তান?
একমাত্র বাস্তবতার সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত রাজনীতি আর কৌশল এবং আঞ্চলিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতনতা দিয়েই এই পরিস্থিতির উন্নতি করা সম্ভব। আবেগ দিয়ে, জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক বক্তব্যের উপর জোর দিয়ে এখানে কোন কাজ হবে না।