মাদক কারবারিদের আত্মসমর্পণ করানোর নামে প্রদীপের বাণিজ্য

0

কক্সবাজারের টেকনাফ থানার সদ্য প্রত্যাহার হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে প্রতিদিনই মিলছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। টেকনাফের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে থাবা পড়েনি এই বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তার। এমনকি গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি ১০২ মাদক কারবারিকে আত্মসমর্পণ করানোর নামেও প্রদীপ মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে তথ্য উদঘাটন হচ্ছে। যারা চাহিদা অনুযায়ী অর্থ দিতে পেরেছেন কেবল তারাই তখন আত্মসমর্পণ করতে পেরেছেন। আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে অনেকের কাছ থেকে ২ লাখ থেকে শুরু করে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছেন প্রদীপ ও তার সহযোগীরা।

তবে মোটা অঙ্কের অর্থ দেওয়ার পরও কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন এমন ঘটনাও রয়েছে। তাদেরই একজন ইয়াবা কারবারের অন্যতম গডফাদার হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সাইফুল করিম। ওসি প্রদীপ সব ধরনের সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে মিয়ানমার থেকে দেশে ফিরিয়ে এনেছিলেন বলে অভিযোগ সাইফুল করিমের পরিবারের সদস্যদের। তারা বলছেন, সাইফুলকে ক্রসফায়ার থেকে বাঁচানোর নামে প্রদীপ ও তার সহযোগীরা ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু অর্থ নেওয়ার পরও সাইফুল বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন। টেকনাফের অনেক ভুক্তভোগী দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ না পেলে মাদক কারবারি আখ্যা দিয়ে পৌরসভার গাড়ি দিয়ে বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দিতেন প্রদীপ ও তার সহযোগীরা। এভাবে গত এক বছরে রাতের আঁধারে দেড় শতাধিক বাড়িঘর ভেঙে দিয়েছেন ওসি প্রদীপ ও তার লোকজন। অনেকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে রক্ষা করেছেন ঘরবাড়ি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তালিকায় কক্সবাজার ও টেকনাফে ১১৫১ জন মাদক কারবারির তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। তার মধ্যে ৭৩ জন শীর্ষ মাদক কারবারি বা পৃষ্ঠপোষকের নাম ছিল। ওই তালিকায় সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি ও তার পরিবারের ২৬ সদস্যের নাম ছিল। তবে বদি তদবির করে তালিকা থেকে তার নাম বাদ দেওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেন। ওই প্রতিবেদনে তালিকাভুক্ত মাদক কারবারিদের সম্পদের বিষয়টিও উঠে আসে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা প্রাথমিক তদন্ত করে নিশ্চিত হন যে প্রত্যেক মাদক কারবারি অঢেল সম্পদের মালিক। এলাকায় তাদের আছে বড় বড় অট্টালিকা। তাছাড়া চট্টগ্রামেও কারও কারও ফ্ল্যাট-বাড়ি আছে। আবার কেউ কেউ দুবাই, সৌদি আরব ও মিয়ানমারেও সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। আর এই সুযোগটি নেন টেকনাফের আলোচিত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। প্রধানমন্ত্রী দেশকে মাদকমুক্ত করার ঘোষণা দেওয়ার পর ২০১৮ সালের ৪ মে থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ অভিযান চালায় পুলিশ ও র‌্যাব। বিশেষ করে কক্সবাজার ও টেকনাফে একের পর এক বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় দিশেহারা হয়ে পড়ে মাদক কারবারিরা। প্রশাসন ঘোষণা দেয়, যারা আত্মসমর্পণ করবে তাদের বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করা হবে। তখন ক্রসফায়ার থেকে নিজেদের বাঁচাতে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে মাদক কারবারিরা। আর এই সুযোগ নেন প্রদীপ ও তার সহযোগীরা। তাদেরকে টাকা দিয়ে অনেক মাদক কারবারি পুলিশ হেফাজতে চলে যায়। প্রদীপের নির্দেশে তখন টেকনাফ থানার এসআই দীপক বিশ্বাস, কনস্টেবল আবদুল আজিজ, কনস্টেবল মহিউদ্দিন, কনস্টেবল রুবেল দাশ, এএসআই আমির হোসেন, এসআই জামসেদ ও এএসআই সঞ্জিব দত্ত আত্মসমর্পণকারীদের পরিবারের কাছ থেকে মাথাপিছু নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

টেকনাফের জালিয়াপাড়ার গরু ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলমের ছোট ভাই মোহাম্মদ আলী জানান, প্রদীপের নির্দেশে তাদের ৪ লাখ টাকা দিতে হয়েছে। পশ্চিম লেদার নুরুল হুদা সোহাগ নামে এক ব্যক্তির আত্মীয় জানান, তখন ২ লাখ টাকা নিয়েছে পুলিশ। পূর্ব হিল্লার ফরিদ আলমের ভাই মোহাম্মদ আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার ভাইকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার আগে প্রদীপ সরাসরি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কনস্টেবল আবদুল আজিজের কাছে ৬ লাখ টাকা দেওয়া হয়।’

সাইফুল করিমের স্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মিয়ানমার থেকে আসার আগে প্রদীপের সঙ্গে যোগাযোগ করেন সাইফুল। প্রদীপ সহায়তার আশ্বাস দিলে তিনি দেশে আসার পরিকল্পনা নেন। ক্রসফায়ার না দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে সাইফুলের পরিবারের কাছ থেকে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা নেন প্রদীপ। তাকে নগদে ওই টাকা দেওয়া হয়।

পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘গত বছরের ২৫ মে রাতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের (বিজি-০০৬১) ফ্লাইটে করে ইয়াঙ্গুন থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন সাইফুল। তার বোর্ডিং পাসে নাম লেখা ছিল করিম সাইফুল। সাইফুল করিমের আসার খবর আগেই নিশ্চিত হই। ফ্লাইট থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে তাকে আমাদের হেফাজতে নিয়ে নেই। তবে একটি সংস্থা চেয়েছিল তাকে তাদের হেফাজতে নিয়ে যেতে। কিন্তু আমাদের বাধার মুখে তারা নিতে পারেনি। আত্মসমর্পণের নামে সে (প্রদীপ) টাকা কামাই করেছে, সে তথ্য আমরা পেয়েছি। সাইফুল করিমের কাছ থেকে সে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কক্সবাজার জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হলে সাইফুল করিম বিমানে করে দুবাই চলে যান। কয়েক মাস থাকার পর ওই দেশ থেকে তিনি মিয়ানমার চলে আসেন। মিয়ানমারে তার মামা মোহাম্মদ ইব্রাহিমের কাছে আশ্রয় নেন। মূলত ইব্রাহিমের মাধ্যমেই সাইফুল ইয়াবার চালান নিয়ে আসেন। এত বড় ইয়াবা ডন হলেও তার বিরুদ্ধে মামলা ছিল অনেক কম। তবে ২০১৭ সালে কয়েকটি মাদক মামলায় আসামি হয়ে পড়েন সাইফুল করিম। ২০১৮ সালে কয়েকটি সংস্থার সমন্বয়ে করা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় ১ হাজার ১৫১ জনের মধ্যে শীর্ষে থাকে তার নাম। আর ওই তালিকা ধরেই সারা দেশে জোরালো অভিযান শুরু করে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর কোনো উপায় না দেখে সাইফুল করিম গা ঢাকা দেন।

এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘সাইফুল করিমকে কারা পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, কারা আর্থিক সুবিধা নিয়েছে তাদের প্রত্যেকের নাম বলেছে। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসাধু কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতা এবং গণমাধ্যমকর্মীও রয়েছেন। তাকে বাঁচানোর নামে টেকনাফ থানা পুলিশ টাকা নিয়েছে বলে আমরা নিশ্চিত।’

টেকনাফের রমজান নামে এক ব্যবসায়ী জানান, টাকা না পেয়ে শিলখালী বানিয়াপাড়া এলাকার সাইফুল নামে এক ব্যক্তিকে শীর্ষ ইয়াবা কারবারি সাজিয়ে বাড়ি ভেঙে দেন ওসি প্রদীপ। সাইফুল কখনো মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত ছিল না। বাড়িটি ভাঙতে এলে তা না করতে ওসির কাছে এলাকার লোকজন আকুতি-মিনতি করেন। তারপরও মাদক কারবারি আখ্যা দিয়ে বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেন প্রদীপ।

রমজান আরও বলেন, প্রশাসনের সবাই জানে সাইফুলদের আর্থিক অবস্থা ভালো। কেউ প্রমাণ করতে পারবে না ইয়াবার টাকায় বাড়ি তৈরি হয়েছে। টাকা না পেয়ে এই কাণ্ড ঘটিয়েছিল প্রদীপ সিন্ডিকেট। তারা জালিয়াপাড়া এলাকার সালমান ও জিকুর তিনটি বাড়িও ভেঙে দিয়েছে। তাছাড়া টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের মেম্বার শামসুল আলম, সাবরাং বাজারপাড়ার বাসিন্দা ও শামসুলের শ্বশুর হাজি নূরুল আমিন, সদর ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের সদস্য এনামুল হক, ইউপি সদস্য আবদুল্লাহ, হ্নীলা ইউপি সদস্য নূরুল হুদা, সাইফুল করিমের ভাগ্নি জামাই ও টেকনাফ পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূরুল বশর নুরশাদ, মৌলভীপাড়ার আবদুর রহমান, নাজিরপাড়ার জিয়াউর রহমান এবং নূর মোহাম্মদের বাড়ির একাংশ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ দিলে বাড়ি ভাঙতেন না প্রদীপ। স্থানীয় প্রশাসন সব জেনেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

এলাকায় মাদক কারবারি হিসেবে পরিচিত নূর মোহাম্মদের দূরসম্পর্কের আত্মীয় মোহাম্মদ ফারুক বলেন, ‘এক বছর আগে অত্যাধুনিক দ্বিতল বাড়িসহ ৪০ শতক জমি বিক্রি করেন নূর মোহাম্মদ। ওসি বিষয়টি টের পেয়ে বাড়িতে উপস্থিত হন। তাকে ৩০ লাখ টাকা দেওয়া হয়।

ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, ‘আত্মসমর্পণের নামে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। ওসি প্রদীপ অনেক অপকর্ম করেছে বলে এখন আমরা জানতে পারছি। দায়িত্ব পালনের সময় প্রদীপ এমনভাবে কথাবার্তা বলত যে তার অপকর্মের বিষয়টি বুঝতে পারিনি। কক্সবাজার ও টেকনাফকে মাদকমুক্ত করতে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি এবং আমরা সেদিকেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু একটি ঘটনায় কিছুটা ছন্দপতন হয়েছে। আশা করি সব ঠিক হয়ে যাবে।’

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com