বিচারব্যবস্থার ইসলামি দৃষ্টিকোণ

0

আদালতে বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু সুনির্দিষ্ট আইন-কানুন থাকে। এসব আইন-কানুন যতই নিখুঁত হোক না কেন যদি বিচারক উপযুক্ত না হন তবে এসবের কার্যকারিতা থাকে না। ন্যায়ভিত্তিক বিচারব্যবস্থা প্রকৃতার্থে নবী করিম সা:-এর আমলেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রাসূল সা: অল্পবয়স্ক আলী রা:কে ইয়েমেনের বিচারক নিয়োগ করলে তিনি বললেন, ‘বিচার সম্পর্কে আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। উত্তরে রাসূল সা: বললেন, আল্লাহ অচিরেই তার বিবেককে সুদৃঢ় করে দেবেন এবং তার অন্তঃকরণে হেদায়াতের নূর পয়দা করে দেবেন।’ স্মর্তব্য, একটি ইংরেজি প্রবচন এরূপ যে, ‘চেয়ার মেকস এ ম্যান’। তবে পার্থক্য এই, এ প্রবচনটি আল্লাহর হেদায়াতের আলোর ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়; বরং ইংরেজ বিচারকদের আইনগত মনোভঙ্গির প্রতিফলন মাত্র। যাই হোক, রাসূল সা: আলী রা:কে সুবিচারের একটি সংক্ষিপ্ত নির্দেশনায় বললেন, তার সামনে বাদি-বিবাদি বিচারের প্রার্থী হলে তিনি যেন উভয় পক্ষের মতামত না শুনে একপক্ষের অনুকূলে রায় না দেন। কারণ উভয় পক্ষের মতামত মনোযোগের সাথে শুনলে তা মামলার সঠিক প্রকৃতি উপলব্ধি এবং রায় ঘোষণা করার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে। আলী রা: বলেন, ‘এরপর থেকে বিচার নিষ্পত্তিতে তিনি কখনো দ্বিধা-সংশয়ে ভোগেননি।’ (তিরমিজি, আবু দাউদ ও ইবনে মাজা)

কোনো বিষয়ে সঠিক বিচার পেতে উপযুক্ত আইনের পাশাপাশি বিচারকের নৈতিক দৃঢ়তার বিশেষ ভূমিকা থাকে। বিচারক নিয়োগের ভার প্রধানত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শাসনকর্তা বা ইসলামী পরিভাষায় ‘খলিফা’র ওপর ন্যস্ত থাকে। তাই রাসূল সা: বলেন, ‘যদি কোনো ব্যক্তির ওপর মুসলমানদের কোনো বিষয়ের দায়িত্ব ও শাসনভার অর্পণ করা হয়, আর ওই ব্যক্তি যদি কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে এমন কোনো ব্যক্তিকে নির্বাচন করে যার থেকে যোগ্য ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এবং কুরআন-সুন্নাহ সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী মানুষ তাদের সমাজে আছে বলে তার জানা থাকে, তবে সে ব্যক্তি আল্লাহ, রাসূল ও মুসলিম সমাজের (স্বার্থের) খেয়ানত করল।’ (তাবারানি, দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, ২০০০, পৃষ্ঠা-৫৭১) বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা, বিচার সহজলভ্য করা এবং ন্যায়বিচারের সুফল যাতে জনগণের কাছে পৌঁছে সেই লক্ষ্যে ইসলামী বিচারব্যবস্থায় কিছু নীতিমালার প্রতি লক্ষ্য রাখা জরুরি- (ক) বিচারপ্রার্থীকে বিচারকের কাছে পৌঁছতে যেন কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করা হয়। কেননা, আদালতের দরজা দরিদ্র, অসহায় ও মজলুম মানুষের জন্য ইসলাম উন্মুক্ত করে দিয়েছে। রাসূল সা: বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর কোনো বান্দাকে যদি মুসলমানদের কোনো বিষয়ে শাসন ও দায়িত্বভার অর্পণ করেন, তারপর সে ব্যক্তি যদি অভাবগ্রস্ত ও অসহায় লোকদের তার কাছে পৌঁছার ক্ষেত্রে কোনো বাধা সৃষ্টি করে রাখে, তাহলে আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ ও অভাব মোচনের ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করে রাখবেন’ (তিরমিজি)। (২) বিশ্বখ্যাত ‘শামী’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে- (ক) বিচারক যেখানেই বিচার করুন না কেন সেখানে যেন সর্বসাধারণের প্রবেশের অনুমতি থাকে; তিনি যেন (খ) কারো কাছ থেকে কোনো উপহার গ্রহণ না করেন; (গ) কারো বিশেষ দাওয়াতে অংশ গ্রহণ না করেন; (ঘ) সর্ব বিষয়ে বাদি-বিবাদি উভয় পক্ষের প্রতি সমতা বজায় রাখেন; (ঙ) কোনো একপক্ষের সাথে গোপন আলাপ, উচ্চস্বরে কথাবার্তা বলা, মুখোমুখি হাসা, তাদের সম্মানার্থে দাঁড়ানো- এ জাতীয় আচরণ থেকে বিরত থাকেন; (চ) বিচার মঞ্চে বসে ঠাট্টা-মশকরা না করেন; (ছ) সাক্ষী কেমন করে সাক্ষ্যবাক্য উচ্চারণ করবে তা না শেখান; (জ) আদালতে কোনো পক্ষ এমন কথা বলবে না যা অপরপক্ষ বুঝতে অপারগ।’ (দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, ২০০০, পৃষ্ঠা ৫৭১-৫৭২)

বিচারালয়ে বাদি প্রমাণ পেশ করবে। যদি সে প্রমাণ করতে না পারে, তাহলে বিবাদির কাছ থেকে শপথ গ্রহণ করা হবে। রাসূল সা: বলেন, ‘প্রমাণ পেশ করা বাদির কর্তব্য। আর বিবাদির জন্য শপথ করা বাধ্যতামূলক।’ (বায়হাকি) শরিয়তবিরোধী না হওয়া পর্যন্ত সর্বাবস্থায় বাদি ও বিবাদি সন্ধি করতে পারে। এ ব্যাপারে বিচারক তার বিবেচনা মতে ফায়সালা দেয়ার পর পুনর্বিবেচনা করার এখতিয়ার রাখেন। মামলা পেশ করার একটি নির্দিষ্ট দিন ধার্য থাকা উচিত। দূরদেশী বা ভিনদেশী লোকের শুনানি আগে হওয়া উচিত। অনুরূপভাবে মামলার একপক্ষ সচ্ছল ও অপরপক্ষ অসচ্ছল হলে, আচরণের দিক থেকে অসচ্ছলদের প্রতি সহায়তার দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। মুসলমান মাত্রই মামলার সাক্ষ্য দানের উপযুক্ত। তবে যদি কোনো ব্যক্তি অতীতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে বা সাজাপ্রাপ্ত হয়ে থাকে বলে প্রমাণিত হয়, এ জাতীয় ব্যক্তি আদালতে সাক্ষ্যদানের অনুপযুক্ত। ‘বিচারক রাগান্বিত বা অশান্ত বা খিটখিটে অবস্থায় বিচারকার্য পরিচালনা করা অনুচিত।’ (বুখারি ও মুসলিম) বিচারালয়ে এমন কোনো কথাবার্তা হওয়া উচিত নয় যাতে কোনো পক্ষের প্রতি জোর-জবরদস্তি প্রমাণিত হয়। পুরুষ ও মহিলার সাক্ষ্য আলাদা আলাদা স্থানে শ্রবণ করা কাম্য। কোনো বিষয় পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত রায় ঘোষণা না করাই উচিত। দরকার হলে সময় বাড়িয়ে নেয়া উত্তম। কোনো মামলার ব্যাপারে রায় দিতে নিম্ন আদালত অপারগ হলে তা উচ্চ আদালতে প্রেরণ করা উচিত। বিচারকের আসনে বসে উপদেষ্টাদের কাছ থেকে মতামত গ্রহণ করা কাম্য নয়। প্রয়োজনে ভিন্নভাবে উপদেষ্টার মতামত নেয়া যেতে পারে। রায় ঘোষণার সময় বিচারক বলবেন, তিনি এই আদালতের বিচারক হিসেবে রায় ঘোষণা করছেন। রায় এমন মার্জিত ভাষায় হওয়া কাম্য যেন বাদি-বিবাদি আতঙ্কিত হয়ে না পড়ে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সর্ব বিষয়ে আল্লাহর হুকুম ও রাসূল সা:-এর আদর্শের প্রতি লক্ষ্য রাখা অপরিহার্য। বিচারকের উচিত আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করা যেন তিনি তাকে বিচার বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার তাওফিক দেন।

ইসলামী বিচারব্যবস্থার লক্ষ্য হচ্ছে জনগণের মধ্যে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। এ ব্যাপারে কুরআন ও হাদিসে বিশেষ তাগিদ রয়েছে। কুরআনে উল্লেখ রয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দেন, তোমরা আমানত পৌঁছে দাও তার প্রাপকদের কাছে। আর তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদের যে উপদেশ দেন, তা কত উৎকৃষ্ট।’ (সূরা নিসা : আয়াত-৫৮) ‘আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা ও সদাচারের নির্দেশ দেন।’ (সূরা নাহল : আয়াত ৯০)। আল্লাহ আরো বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর সাক্ষীস্বরূপ ন্যায়বিচারে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাকবে, যদিও তা তোমাদের নিজেদের অথবা পিতা-মাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে যায়, সে বিত্তবান হোক বা বিত্তহীন হোক আল্লাহ উভয়েরই ঘনিষ্ঠ। সুতরাং তোমরা ন্যায়বিচার করতে প্রবৃত্তির অনুগামী হবে না। যদি তোমরা প্যাঁচালো কথা বলো অথবা পাশ কেটে যাও তবে তোমরা যা করো, আল্লাহ তার সম্যক খবর রাখেন।’ (সূরা নিসা : আয়াত-১৩৫)

বিচারকের বিচারের দায়িত্ব ও পরিণাম সম্পর্কেও ইসলাম সতর্ক করে দিয়েছে। অন্যায় বিচারের মন্দ পরিণাম এবং ন্যায়বিচারের প্রতিদান প্রসঙ্গে রাসূল সা: বলেন- ‘বিচারক তিন প্রকার : এক প্রকার বিচারক জান্নাতবাসী হবে। আর দুই প্রকার বিচারক জাহান্নামি হবে। জান্নাতি বিচারক হচ্ছে ওই ব্যক্তি যে হক (সত্য) জেনে সে মুতাবেক ফায়সালা করেছে। যে ব্যক্তি হক বা সত্য জানা সত্ত্বেও আদেশ দানের ক্ষেত্রে অন্যায়ের আশ্রয় গ্রহণ করে সে হবে জাহান্নামি। আর যে ব্যক্তি অজ্ঞ অবস্থায় বিচারকার্য সম্পাদন করে, সেও জাহান্নামি হবে।’ (আবু দাউদ ও ইবনে মাজা), উপরন্তু তিনি আরো বলেন, ‘বিচারক অন্যায় না করা পর্যন্ত আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন। যখন সে জুলুম করে তখন আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন না এবং শয়তান তার সঙ্গী হয়ে যায়।’ (তিরমিজি ও ইবনে মাজা)

মূল কথা হচ্ছে, ইসলামী আইনের নিরিখে শাসক-শাসিত, ধনী-গরিব, ছোট-বড় এবং আপন-পরের মধ্যে কোনো তারতম্য ও পার্থক্য নেই। রাসূল সা: দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে। এ জন্য যে তাদের কোনো সম্মানিত লোক চুরি করলে তখন তারা তাকে রেহাই দিয়ে দিত। আর যখন কোনো দুর্বল লোক চুরি করত তখন তারা তার ওপর শাস্তি প্রয়োগ করত। আল্লাহর কসম! মুহাম্মদের কন্যা ফাতেমাও যদি চুরি করে, তবে অবশ্যই মুহাম্মদ সা: তার হাত কেটে দেবেন।’ (বুখারি) আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান; এ ব্যাপারে কোনো তারতম্য নেই। উমর রা:-এর খিলাফতকালে মদ্যপানের অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হলে বিশিষ্ট ব্যক্তি আবান পুত্র আবু শাহমাকে দণ্ড দিলেন। এটি ইসলামী আইনে ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার একটি উদাহরণ মাত্র।

লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও ভাইস প্রিন্সিপাল, মহিলা সরকারি কলেজ, কুমিল্লা

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com