আঞ্চলিক বিন্যাসের গোপন আয়োজন!

0

মধ্যপ্রাচ্যের পরিবর্তন ঘটানোর গোপন আয়োজন নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে অতি সম্প্রতি নতুন নতুন তথ্য ও বিশ্লেষণ আসছে। এর কিছু দৃশ্যপটের অন্তরালে ঘটছে, আর কিছু বিভিন্ন দেশের রণক্ষেত্রগুলোতে দৃশ্যমান হচ্ছে। এ ধরনের একটি তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য ও বিশ্লেষণ নিয়ে এসেছেন তুর্কি কলামিস্ট নেদারেট এরসানেল।

তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরব থেকে তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং রণতরী প্রত্যাহার করতে চলেছে; ইরানের সাথে বন্দিবিনিময় হচ্ছে; সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কুয়েত ও কাতার ইরানের সাথে স্বচ্ছ সম্পর্ক নির্মাণ করতে চাইছে; নতুন সরকারের জন্য ইরাক-বাগদাদ প্রশাসন নিয়ে ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছে; আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত অনুসারে ইরাকে ইরানের বিদ্যুৎ বিক্রয় চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে; সিরিয়ায় বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে নতুন ও তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি সাধিত হতে চলেছে; ভেতরের খবর অনুসারে, বাশার আসাদ রাশিয়ার গুডবুকে আর নেই; জেমস জেফরি রাশিয়ার সাথে এটি নিয়ে কাজ করার কথা বলেছেন; তার আগে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, যারা ২০১১-এর পরে সিরিয়ায় এসেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, ইরান- তাদের সিরিয়া থেকে বেরিয়ে আসা উচিত; ইসরাইলের ঘোষণাপত্রে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এত দিন অবধি ইরানকে সিরিয়ায় আসা থেকে বিরত করার চেষ্টা করছিল ইসরাইল, এখন তারা সিরিয়া থেকে ইরানকে বের করে দেয়ার জন্য লড়াই করছে; অন্য দিকে ফ্রান্স ও আমেরিকা উভয়কেই এক দল করতে এবং একটি আন্তর্জাতিক সংলাপ গঠনের লক্ষ্যে উত্তর সিরিয়ার কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে), পিপলস প্রটেকশন ইউনিট (ওয়াইপিজি) এবং সিরিয়ান কুর্দিশ জাতীয় কাউন্সিলকে একত্র করা হচ্ছে।’

নেদারেট এরসানেলের উল্লিখিত তথ্য বা গুজব যেটি বলি না কেন মধ্যপ্রাচ্যের নতুন কোনো পরিবর্তনের যে আয়োজন চলছে তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। যুক্তরাষ্ট্রে যখন করোনা পরিস্থিতি নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের গলদঘর্ম অবস্থা, করোনার কারণে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে, তখন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পেও ইসরাইল সফর করেছেন। এটি এমন এক সময় ঘটেছে যখন পশ্চিম তীরে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা নিয়ে ফিলিস্তিনিদের সাথে ইসরাইলের তীব্র উত্তেজনা চলছে। লিবিয়া পরিস্থিতি নিয়ে আমিরাত, সৌদি আরব, মিসর, ফ্রান্স ও গ্রিস একযোগে তুরস্কের সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়েছে। সঙ্গতকারণেই সময়টা যেমন তাৎপর্যপূর্ণ তেমনিভাবে সিরিয়া, ইরাক ও লিবিয়ার জন্য এসব বিষয় মাঠ পরিস্থিতিতে বিশেষ প্রভাব ফেলার মতো।

এরসানেলের বক্তব্যটিকে বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের নতুন অবয়ব দানের একটি অংশ বিবেচনা করা যেতে পারে। একই সাথে এর মধ্যে লিবিয়া এবং তার পর মিসর, মাল্টা, ইতালি ও তিউনিসিয়াসহ ভূমধ্যসাগরীয় অববাহিকা নিয়ে নতুন এক মূল্যায়নের বিষয়ও রয়েছে। এখন পর্যন্ত এটি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে, এ অঞ্চলের ঘটনাগুলো কি প্রাকৃতিক কোনো ফলাফল, নাকি রাজনৈতিক ও মহামারী সঙ্কট খেলোয়াড়দের নতুন স্থানে ঠেলে দিয়েছে। তবে এখানে তুরস্ক-ইসরাইল সম্পর্কের প্রত্যাশাও যুক্ত হতে পারে। প্রশ্ন হলো, এই যুগপৎ ঘটনাধারার মধ্যে কী ধরনের আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে? এসব ক্ষেত্রে তুরস্কের ভূমিকাই বা কী?

লিবিয়া সম্পর্কিত তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রকের সর্বশেষ বক্তব্য হলো তুরস্কের স্বার্থকে লক্ষ্য করে আক্রমণ খলিফা হাফতারকে বৈধ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করবে। এর মাধ্যমে তাকে সমর্থনকারী বাহিনীর কাছেও একটি বার্তা দেয়া হয়েছে আর হাফতারকে চূড়ান্তভাবে সতর্কও করা হয়েছে।

এখন এটাও ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে যে, সিরিয়া ও লিবিয়ার ঘটনার মধ্যে একধরনের আন্তঃসংযোগ রয়েছে। এর সমাধান এবং উভয় সঙ্কট নিয়ে আলোচনার টেবিলে কার বক্তব্য থাকবে তা ক্ষমতার মহাখেলার একটি অংশ; দুই দেশই তুরস্কের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অঞ্চল এবং কূটনীতির টেবিলে তার শক্তি সংরক্ষণ চূড়ান্ত অবস্থার দিকে। তবে সিরিয়া ও লিবিয়ার ইস্যুটি ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের সাথেও সম্পর্কিত। মানচিত্রটি একই রিংয়ের মধ্যে প্রসারিত হয় এবং এ বিষয় নিয়ে অসম্পৃক্ত থাকতে চাইলেও এটি সামনে হাজির হবে।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা বিষয়ক বিশেষ দূত মিখাইল বোগদানভ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত মার্কাস এদারার সিরিয়া ও লিবিয়ার বিষয়ে এক টেলিফোন কথোপকথন করেছেন। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার সর্বশেষ রাজনৈতিক অগ্রগতি এবং লিবিয়া ও সিরিয়া সঙ্কট ছাড়াও তারা ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব নিয়েও আলোচনা করেছেন। দ্বি-রাষ্ট্রীয় নীতির ভিত্তিতে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে আলোচনার সুবিধার্থে রাশিয়া ও ইইউ এবং মধ্যপ্রাচ্যের চতুষ্পদীয় প্রচেষ্টা সমন্বয়ের জন্য তারা গুরুত্ব দিয়েছেন। এ তথ্য জানিয়েছে রাশিয়ান বার্তা সংস্থা তাস।

বড় ছবিটির দিকে তাকালে বোঝা যায় যে, সিরিয়ায় ইরানকে প্রতিষ্ঠিত করে ইরাকে তার ভূমিকা কমানোর একটি কৌশল নিয়ে সম্ভবত কাজ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের দ্বন্দ্ব হ্রাস করে ইরাকে যৌথ বন্দোবস্তের একটি প্রস্তুতি চলছে বলে মনে হয়। এটি কিভাবে কাজ করবে, মাঠের জটিলতাগুলো এর জন্য কাজ করার সুযোগ দেবে কি না সেটি আলাদা বিষয়।

সার্বিকভাবে সিরিয়া ও ইরাক যুদ্ধে এক ধরনের স্থবিরতা রয়েছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইরাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিটগুলোতে ইরান-প্ররোচিত হামলায় এ স্থবিরতার বিষয়টি বোঝা যায়। পেন্টাগন ও ইরাকি সরকার জুনে বাগদাদে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি নিয়ে এক বৈঠক করতে যাচ্ছে। এতে এটি মনে হয় যে, আমেরিকা আসলেই ইরাক ছাড়ছে না। এটি তার জন্য প্রকৃতির বিরুদ্ধ একটি বিষয় হবে। ইসরাইলও এর সাথে নানাভাবে যুক্ত হয়ে পড়ছে।
এটা স্পষ্ট যে, নতুন যে ঘটনাপ্রবাহের কথা বলা হচ্ছে তাতে তুরস্কের দক্ষিণ সীমান্তে তিনটি দেশের জন্য নির্দিষ্ট ফলাফল সৃষ্টি হবে। এর সবই তুরস্কের জন্য উদ্বেগের এবং এতে তুর্কি হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হতে পারে।

তুরস্ক, রাশিয়া, ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে কোনো জোট হিসেবে নয়, তবে সিদ্ধান্ত প্রণেতা হিসেবে রয়েছে এবং সময়ে সময়ে তারা অংশীদারিত্বের জন্য বসে এবং কখনো কখনো পরস্পরের বিরোধী শক্তি হিসেবে মুখোমুখি হয়। তবে এ ক্ষেত্রে মূল প্রত্যাশিত ঘটনাটি হলো মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। কেবল এ নির্বাচনের পরে জোট এবং নীতিগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

ক্রেমলিনের কাছে একটু ইরান মানেই একটু ইসরাইল। এর অর্থ বিরোধমূূলক অঞ্চলগুলোতে সঙ্কটের বিবর্ণতা। এর অর্থ সিরিয়া, ইরাক ও লিবিয়ায় পাস। এখন একটি নতুন চাকা ঘুরছে কৌশলগত দিক থেকে আর জোটের অংশীদারিত্বে তুরস্ক হলো প্রাকৃতিক অভিনেতা। সাধারণ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র-চীন তালিকায় এর পরে রয়েছে। এটি সত্যি একটি কঠিন বিষয়। আঙ্কারা এখানে একটি পছন্দ করতে চলেছে! তবে অন্য সবার চেয়ে বিস্ময়কর পছন্দ। প্রশ্ন সামনে এসেছে, এভাবেই কি ‘মধ্যপ্রাচ্যের গোপন ভাণ্ডার’ প্রকাশিত হতে চলেছে! তবে অস্বাভাবিক অবস্থা হতে পারে ট্রাম্পের পরাজয়। সেক্ষেত্রে বিশ্ব নীতিপ্রণেতাদের একসাথে বসে সব কিছু আবার ঠিক করতে হবে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com