আল্লাহর নৈকট্য লাভের অনন্য উপায় : ইতেকাফ

0

ড. মুহাঃ আবু ইয়াছিন

ইতেকাফ আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম। আল্লাহর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার সহজ উপায়। কারণ, মানুষ যখন জগৎ-সংসারের কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে আল্লাহর ঘরে ইবাদতের নিমিত্তে আত্মনিয়োগ করবে, তখন করুণাময় আল্লাহ তার থেকে দূরে থাকতে পারেন না। হাদিসে কুদসিতে তিনি তো ঘোষণাই দিয়েছেন

‘বান্দা আমার দিকে একহাত অগ্রসর হলে আমি তার দিকে দুইহাত অগ্রসর হই। আমার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলে আমি তার দিকে দৌড়ে যাই।’ শুধু তাই নয় তিনি আরও বলেছেন-
‘তোমরা (বান্দা) যদি আমাকে স্মরণ কর, তাহলে আমিও তোমাদের স্মরণ করব।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৫২)

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, কেউ যখন আল্লাহর ঘর মসজিদে অবস্থান নেয় তখন আল্লাহ তাআলা এত বেশি আনন্দিত হন; বিদেশ থেকে কেউ বাড়িতে এলে আপনজন যেমন আনন্দিত হয়ে থাকে।’ (তারগিব-তারহিব)

আল্লাহর স্মরণের জন্য তথা নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে বান্দা একান্তভাবে তার ইবাদত ও ধ্যানের মাধ্যমে আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জনে রমজানের শেষ দশকে মসজিদে অবস্থানের নামই ইতেকাফ।

ইতেকাফ
ইতেকাফ শব্দটি আরবি। যার অর্থ হলো কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করা, কোন জিনিসকে আকড়ে থাকা বা রাখা অথবা কোনো জিনিস থেকে বিরত থাকা, চাই তা ভালো হোক অথবা মন্দ হোক। কুরআনুল কারিমে এ শব্দের ব্যবহার করে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন-
– অবস্থানকারী
وَعَهِدْنَا إِلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ أَن طَهِّرَا بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْعَاكِفِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ
‘আর আমি ইবরাহিম ও ইসমাঈলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার ঘরকে তওয়াফকারী, অবস্থানকারী ও রুকু-সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখ।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১২৫)

– বসে থাকা
إِذْ قَالَ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ مَا هَذِهِ التَّمَاثِيلُ الَّتِي أَنتُمْ لَهَا عَاكِفُونَ
‘যখন তিনি (ইবরাহিম আলাইহিস সালাম) তাঁর পিতা ও তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন, এই মূর্তিগুলো কী, যাদের তোমরা পূজারি হয়ে বসে আছ।’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৫২)

– নিয়োজিত থাকা
وَجَاوَزْنَا بِبَنِي إِسْرَائِيلَ الْبَحْرَ فَأَتَوْاْ عَلَى قَوْمٍ يَعْكُفُونَ عَلَى أَصْنَامٍ لَّهُمْ
‘বস্তুত আমি সাগর পার করে দিয়েছি বনী-ইসরাঈলদের। তখন তারা এমন এক সম্প্রদায়ের কাছে গিয়ে পৌছাল, যারা নিজ হাতে নির্মিত মূর্তি পূজায় নিয়োজিত ছিল।’ (সুরা আরাফ : আয়াত ১৩৮)

ইসলামি শরিয়তে ইতেকাফ
শরিয়তের পরিভাষায়- ‘জামাআত অনুষ্ঠিত হয় এমন মসজিদে পুরুষ আর নারীরা নিজেদের ঘরের নামাজ আদায় করার জায়গায় আল্লাহর নৈকট্য লাভের নিয়তে অবস্থান করাকে ইতেকাফ বলে।’ (কাওয়ায়িদুল ফিকহ) আর যিনি ইতিকাফ করেন তাকে মুতাকিফ বলা হয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَلاَ تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ
‘তোমরা মসজিদে ইতিকাফ অবস্থায় তাদের সাথে (তোমাদের স্ত্রীদের) সাথে সঙ্গম করো না।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১২৭)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইতেকাফ সম্পর্কে অসংখ্য হাদিস বর্ণনা করেছেন। এসব হাদিসে তিনি ইতেকাফ সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন। হাদিসে এসেছে-
– হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন।’ (বুখারি)

– হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন। তাঁর ওফাত পর্যন্ত এই নিয়মই ছিল। এরপর তাঁর স্ত্রীগণও সে দিনগুলোতে ইতেকাফ করতেন।’ (বুখারি)

– হজরত উবাই ইবনু কাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান মাসের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন। এক বছর তিনি ইতেকাফ করতে না পারায় পরবর্তী বছর ২০ দিন ইতেকাফ করেছেন।’ (আবু দাউদ)

– হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক রমজান মাসের (শেষ) ১০ দিন ইতেকাফ করতেন। তারপর যে বছরে তিনি দেহত্যাগ (ইন্তেকাল) করেন, সে বছরে ২০ দিন ইতেকাফ করেছিলেন।’ (রিয়াদুস সালেহিন, বুখারি, তিরমিজি, আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ, দারেমি)

ইতিকাফের বিধান
ইতেকাফ তিন ধরনের হয়। আর তাহলো-
– ওয়াজিব,
– সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ ও
– মুস্তাহাব।

-ওয়াজিব ইতেকাফ
মানতের ইতিকাফ। যদি কেউ রমজানের ইতেকাফের মানত করেন তাহলে তার এ মানত সহীহ হবে। মানত করার পর যদি সে রমজানের রোজা রাখে, ইতেকাফ না করে, তবে তার উপর অন্য মাসে রোজাসহ লাগাতার ইতিকাফের কাজা আদায় করা ওয়াজিব। পরবর্তী রমজানে ঐ ইতেকাফের কাজা করলে তা আদায় হবে না।

– সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ ইতেকাফ
রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ কেফায়া, অর্থাৎ বড় শহর বা গ্রামের প্রত্যেক মহল্লা এবং ছোট গ্রামের পুর্ণ বসতিতে কেউ কেউ ইতেকাফ করলে সবাই দায়িত্বমুক্ত হবে। আর কেউ না করলে সুন্নাত তরকের জন্য সবাই দায়ী হবে।

– নফল ইতেকাফ
নফল ইতেকাফের জন্যে রোজা রাখা শর্ত নয়। কিন্তু মানতের ইতেকাফের জন্যে রোজা রাখা শর্ত। নফল ইতেকাফের জন্য নির্দিষ্ট কোনো মেয়াদ নেই। অল্প সময়ের জন্যও নফল ইতেকাফ করা যায়। মসজিদে অবস্থানকালীন সময়ে ইতেকাফের নিয়তের সাথে অবস্থান করাই উত্তম। অর্থাৎ মসজিদে প্রবেশের এ নিয়ত করা- আমি যতক্ষণ মসজিদে অবস্থান করবো, তা যেন ইতেকাফের অন্তর্ভূক্ত হয়।

ইতেকাফে যাওয়ার সময়
ইতেকাফকারী রমজানের ২০ তারিখ আসরের পর ইফতারের আগে শেষ দশকের ইতেকাফের নিয়ত করে মসজিদে প্রবেশ করবে। তারপর ২৯ রমজান শাওয়ালের চাঁদ দেখা সাপেক্ষে কিংবা ৩০ রমজান পূর্ণ হলে ইফতারের পর ইতেকাফ পূর্ণ হবে। তারপর ইতেকাফকারী চাইলে সন্ধ্যায় কিংবা পরদিন সকালে বাড়ি যেতে পারবে।

ইতিকাফ সহিহ হওয়ার শর্ত
– মুসলমান হওয়া,
– জ্ঞানবান হওয়া,
– জানাবাত তথা অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হওয়া।
– নারীদের হায়েজ (মাসিক) ও নিফাসসহ (সন্তান ভূমিষ্টের পর ৪০ দিন) বড় নাপাকি থেকে পবিত্র হওয়া৷
– স্ত্রীদের ইতেকাফে বসায় স্বামীর অনুমতিও শর্ত। অনুমতি ছাড়া কোনো স্ত্রী ইতেকাফ করতে পারবে না।

ইতিকাফ যে কারণে নষ্ট হয়
– ইতেকাফকারী মানবীয় ও শরিয়াত সম্মত প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে যদি মসজিদ থেকে বের হয়। চাই তা ইচ্ছা করে হোক বা ভুলক্রমে হোক। অনুরূপভাবে নারীরা তাদের নির্ধারিত স্থান থেকে বের হবে না।

– জুমার নামাজ আদায় বা পেসাব পায়খানা ইত্যাদি ওজরের কারণে মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে। কিন্তু প্রয়োজন পুর্ণ হওয়ার পর যদি অল্প সময় মসজিদের বাহিরে অবস্থান করে কিংবা দাঁড়িয়ে কথা বলে বা হাসি-তামাশা করে তাহলে তার সুন্নাত ইতেকাফ বাতিল হয়ে যাবে।’ (হেদায়া আউয়াল)

ইতেকাফে আদব
– ইতেকাফ অবস্থায় অপ্রয়োজনীয় কথা না বলা।
– সর্বোত্তম মসজিদ ইতেকাফের জন্য নির্বাচন করা। যেমন : মাসজিদুল হারাম, মসজিদে নববি বা জামে মসজিদ।
– কুরআন-হাদিস অধ্যয়ন করা।
– দ্বীনি ইলম নিজে শেখা এবং অন্যকে শেখানো।
– বেশি বেশি জিকির-আজকার করা।
– নির্ভরযোগ্য ইসলামি বই ও সিরাত গ্রন্থ পড়া।
– মাসআলা-মাসায়েল এর কিতাবাদি পড়া এবং লেখা।
– যে কথায় পাপ হয় তা না বলা।
– যে কথায় পাপ না হলেও পূণ্য নেই তাও না বলা।

ইতেকাফের উপকারিতা ও ফজিলাত
ইতেকাফে থাকা অবস্থায় বাইরের সব গোনাহ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ইতেকাফরত অবস্থায় বান্দা যেন আল্লাহর ঘরে তার সামনেই সার্বক্ষণিক উপস্থিত। যে কারণে আল্লাহর কাছে তার প্রিয় বান্দা ও সম্মানি হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয় আর সে কারণেই আল্লাহ তার প্রতি দয়া-অনুগ্রহ, ক্ষমা ও রহমতের নজর দিয়ে থাকেন। ইতেকাফে থাকা অবস্থায় ইতেকাফকারীর জাগতিক সব কাজ তথা পানাহার ও প্রাকৃতিক প্রয়োজন সবই ইতেকাফের অন্তর্ভূক্ত। (বাদায়েউস সানাঈ ছানি)

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইতেকাফকারী সম্পর্কে বলেছেন, সে গোনাহ পরিত্যাগকারী। সমবসয় কোনো পূণ্যের কাজে অংশগ্রহণকারীর মতো সে সওয়াব পাচ্ছে।’ (বায়হাকি)

হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসের শেষ দশ দিন ইতেকাফ করবেন তিনি দুটি ওমরাহ ও দুটি হজ আদায় করার সওয়াব পাবেন।’ (বায়হাকি, বুখারি)

হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে ইতেকাফ করবে, আল্লাহ তাআলা তার এবং জাহান্নামের আগুনের মধ্যে তিনটি পরিখার দূরত্ব সৃষ্টি করবেন, প্রত্যেক পরিখার প্রশস্ততা দুই দিগন্তের চেয়েও বেশি।’ (বায়হাকি)

ইতেকাফ প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যতম একটি দায়েমি সুন্নাত ইবাদত। ফরজ ইবাদত ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য যেসব ইবাদত করা হয় তার মধ্যে ইতেকাফ অন্যতম।

সুতরাং উপরোক্ত বিষয়সমুহের প্রতি লক্ষ্য রাখলে প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের উচিত রমজানে ইতেকাফ নামক ইবাদতে আত্মনিয়োগ করা। তবেই বান্দা ইতেকাফের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভে হবে অগ্রগামী।

হে আল্লাহ! আপনি মুসলিম উম্মাহকে ইতেকাফের মাধ্যমে আপনার নৈকট্য লাভ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : শিক্ষক, সমসাময়িক ইস্যুতে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গিতে ইসলামিক স্টাডিজের একজন গবেষক ও লেখক।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com