সুনসান নীরবতা, চাপা আতংক হঠাৎ বদলে গেছে হোয়াইটচ্যাপেল

0

টাওয়ার হ্যামলেটসকে বলা হয় বৃটেনে প্রবাসী বাংলাদেশীদের রাজধানী । কারণ এখানে বাস করেন প্রায় ১ লাখ বাংলাদেশী। গোটা বারায় সাদা, কালো, বাদামী সববর্ণ মিলিয়ে মানুষের সংখ্যা ৩ লাখ। আর এরমধ্যে শুধু বাংলাদেশীই ১ লাখ। এখানে মসজিদ আছে প্রায় ৪৫টি। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত জামাতে নামাজ হয়। শুক্রবারে জুমা হয়। ঈদে খোলা মাঠে জামাত হয়। তাই টাওয়ার হ্যামলেটসের রাস্তাঘাটে হাঁটলে মনে হয় যেন বাংলাদেশের কোনো পাড়া-মহল্লায় হাঁটছি। 

এই টাওয়ার হ্যামলেটসের সর্বাধিক বাঙালি অধু্যষিত এলাকা হলো হোয়াইটচ্যাপেল। এখানে আছে দুটো আন্ডার গ্রাউন্ড স্টেশন। বিস্তৃত কাঁচাবাজার, ৫টি হাইস্ট্রিট ব্যাংক, নানা ধরনের বাংলাদেশী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ইউকের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ইস্ট লন্ডন মসজিদ এন্ড লন্ডন মুসলিম সেন্টার। আছে আলতাব আলী পার্ক, শহীদ মিনার এবং আরো কত কিছু। তাই হোয়াইচ্যাপেল সবময়ই বাঙালি কমিউনিটির একটি কেন্দ্রস্থল। দিনরাত এখানে প্রবাসী বাংলাদেশীদের আনাগোনা লেগে থাকে। 

কিন্তু গত ক’দিন ধরে ব্যস্ততম এই এলাকায় কেমন যেন সুনসান নীরবতা। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব প্রাণচঞ্চল মানুষগুলোর হাসি আনন্দ যেন কেড়ে নিয়েছে। সকলের মধ্যে চাপা আতংক। একজন আরেকজনের সাথে দেখা হলে এখন আর আগের মতো জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করছেন না। কনুইর সঙ্গে কনুই মিলিয়ে হ্যান্ডশেক থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছেন।   

শুক্রবার প্রায়ই ইস্ট লন্ডন মসজিদে জুমার নামাজ পড়ার চেষ্টা করি। এখানে নামাজ পড়লে দুটো লাভ হয়। এক. সমসাময়িক পরিস্থিতির ওপর বাংলা ও ইংলিশে জুমার খুতবা শোনা যায়।  তাছাড়া নামাজ শেষে পরিচিতজনের সাথে দেখা সাক্ষাতও হয়ে যায়।

আজকের জুমার খুতবা দিলেন প্রধান ইমাম ও খতীব শায়খ আব্দুল কাইয়ূম। খুতবার বিষয়বস্তু ছিলো- কেন এই করোনাভাইরাস, কীভাবে আমরা বাঁচতে পারি? ইমাম আব্দুল কাইয়ুম বলেন, “কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষ নিজেকে খুব 

বেশি শক্তিশালী মনে করে । তাই আল্লাহ তায়ালা মাঝে মাঝে গজব প্রেরণ করে তিনি তার শক্তি প্রদর্শন করে থাকেন। 

তিনি পবিত্র কুরআনের উদ্বৃতি দিয়ে বলেন, মানুষের পাপের কারণেই আল্লাহ তায়ালা গজব বা শাস্তি প্রেরণ করে থাকেন । তবে এমন কোনো গজব তিনি নাজিল করেন না, যার কোনো চিকিৎসা বা প্রতিষেধক নেই। মানুষকে সেই চিকিৎসা খুঁজে বের করতে হয়। ইনশাল্লাহ করোনাভাইরাসের প্রতিষেধকও খুব শীঘ্রই মানুষ বের করবে আমরা আশাবাদী। তিনি বলেন, পাপের কারণে যখন গজব চলে আসে তখন মানুষের তাওবা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকেনা। মানুষ একান্তভাবে তাওবা করলে আল্লাহ তায়ালা তাঁর গজব তুলে নেন। তাই আমাদেরকে একান্তভাবে তাওবা করতে হবে। 

এদিকে করোনা আতংকে আগামী শুক্রবার ইস্ট লন্ডন মসজিদে 

জুমার খুতবা ও নামাজ মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে শেষ করা হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে । ইস্ট লন্ডন মসজিদ সাধারনত সকাল ১০টায় খোলা হলেও শুক্রবার দুপুর সোয়া ১২টায় খোলা হবে। পৌনে ১টায় খুতবা শুরু হয়ে ১টার মধ্যে নামাজ শেষ করা হবে। বাসা অথবা কর্মস্থলে অজু পড়ে সুন্নাত নামাজ শেষ করে মসজিদে আসতে বলা হয়েছে। তাছাড়া ফরজ নামাজ শেষ করে সুন্নাত ঘরে গিয়ে পড়তে তাগিদ দেয়া হয়েছে। অজুর স্থান ও মসজিদে বেশিক্ষণ থাকা এবং জমায়েত হওয়া থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করা হয়েছে। তাছাড়া এখন থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আগ পর্যন্ত জানাজা শেষে কোনো লাশ এলএমসি হলে খোলামেলাভাবে আর দেখানো হবে না। শুধু পরিবারের লোকজন তসলিম ফিউনারেলে গিয়ে দেখতে পারবেন। 

মসজিদের প্রজেক্টারগুলোতে কারোনাভাইরাস থেকে বাঁচার আরবী দোয়া ও হাতমুখ ধোয়ার নির্দেশনা মিনিটে মিনিটে ডিসপ্লে হচ্ছে। কার্পেটকে জীবানুমুক্ত করতে মারা হচ্ছে বিশেষধরনের স্প্রে। 

শুক্রবারের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে করোনায় ৭৯৮ জন আক্রান্ত বলে শনাক্ত করা হয়েছে। বৃহস্পতিবারের চেয়ে ২০৮ জন বেশি আক্রান্ত হয়েছেন শুক্রবারে। মারা গেছেন সর্বমোট ১১জন । তবে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আশংকা করছেন, আক্রন্তের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। 

সর্বশেষ খবর অনুয়ায়ী, বাঙালি অধু্যষিত টাওয়ার হ্যামলেটসে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৬ জন। তবে শুক্রবার সকাল সাড়ে ৬টায় এক বৃটিশ-বাংলাদেশীর মৃতু্য হয়েছে । তিনি পূর্ব লন্ডনের ক্যাবল স্ট্রিটের বাসিন্দা। মানচেষ্টারে গত ৮ মার্চ এক ইতালিয়ান বাংলাদেশীর মৃতু্যর পর টাওয়ার হ্যামলেটসে দ্বিতীয় কোনো বাংলাদেশী মারা গেলেন। টাওয়ার হ্যামলেটসে এক বাংলাদেশী মারা যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে কমিউনিটিতে আতংক দেখা দিয়েছে। 

যুক্তরাজ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভাষ্য মতে, করোনারভাইরাসের ছোবল দিনদিন প্রকট রূপ লাভ করবে। দুই তিন মাসের মধ্যে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই ইতোমধ্যে সরকারীভাবে কঠোর সতর্কতামুলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী মে মাসে অনুষ্ঠিতব্য লন্ডন মেয়র নির্বাচন পরবর্তী এক বছর পর্যন্ত স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। প্রার্থীদেরকে সবধরনের ক্যাম্পেইন থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছে লেবারদল । স্কুলগুলো আগামী সপ্তাহে বন্ধ ঘোষণা করা হতে পারে। পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে গোটা লন্ডন শহর লকডাউন করে দেয়ারও সম্ভাবনা আছে। 

মানুষ মরণশীল। জন্মের গ্যারান্টি নেই। কিন্তু মৃতু্যর গ্যারান্টি আছে। মৃতু্য কখন কোথায় কীভাবে হবে আমরা জানিনা। মরতে পারি স্থলে, কিংবা জলে অথবা আকাশে। কিন্তু আমরা সকলেই চাই একটি স্বাভাবিক মৃতু্য। মৃতু্যর সময় স্বজনেরা আমাদের পাশে থাকবেন । মারা গেলে ইসলামি রীতি অনুযায়ী মরদেহ গোসল দেয়া হবে । কাফন পরানো হয় । সুগন্ধি লাগিয়ে দাফন করা হবে মুসলিম গোরস্থানে। এটাই আমাদের একান্ত চাওয়া। কিন্তু করোনাভাইরাসে মারা গেলে কি সেই সুযোগটুকু থাকবে? লাশ কি গোসল দেয়া হবে, জানাজা শেষে পরিবার পরিজন আত্মীয়জন মিলে দাফন করতে পারবেন? 

এই প্রশ্নের উত্তরও খুব একটা পজেটিভ নয়। শুক্রবার সন্ধ্যায় কথা হলো তসলিম ফিউনারেল সার্ভিসের কর্মকর্তা আবু খালিদের সাথে । তিনি বললেন, তসলিম ফিউনারেল সার্ভিসের রুম পর্যাপ্ত বড় না হওয়ায় তারা করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের লাশ হ্যান্ডেলিং করা যাবেনা । তাই গার্ডেন্স অব পিস গোরস্থানে খোলা জায়গায় জানাজা ও দাফনের ব্যবস্থা করা হবে । তারা সেখানে বিশেষ ব্যবস্থায় করবেন। তবে সেখানে পরিবারের লোকজন যাওয়ার সুযোগ থাকবে না। গোরস্থানে কর্তব্যরত লোকজনই জানাজা শেষে দাফন করবেন। 

ফিউনারেল সার্ভিসের ডাইরেক্টররা বলেছেন, এ ক্ষেত্রে মর্গ থেকে বডিব্যাগে সীলড করে লাশ হস্তান্তর করা হবে । ব্যাগ থেকে লাশ খোলা যাবে না। গোসলও দেয়া যাবে না। ব্যাগের উপরই তায়াম্মুম পড়িয়ে জানাজা পড়িয়ে দাফন করা হতে পারে। 

তাই তায়ালার কাছে আমাদের একান্ত প্রার্থনা, হে আল্লাহ আমাদের প্রত্যেককে ক্ষমা করে দাও। আমাদের তাওবা কবুল করো। তোমার গজবের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করো। গজব তুলে নাও। সুস্থাস্থ্য দান করো। স্বাভাবিক মৃতু্য দাও। আমিন।  ছবি : ১৩ মার্চ শুক্রবার বিকেলে হোয়াইটচ্যাপেল রোডে ইস্ট লন্ডন মসজিদের সম্মুখে।

লেখক…

তাইসির মাহমুদ

সম্পাদক

সাপ্তাহিক দেশ, লন্ডন। 

শুক্রবার, ১৩ মার্চ ২০২০।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com